একটানা কয়েক হাজার কিমি উড়ে মঙ্গোলিয়া থেকে আফ্রিকা যায় বাজের দল

পরিযায়ী পাখিদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা  

দিন দিন কত প্রাণী যে বিপন্ন প্রজাতির দলে নাম লেখাচ্ছে কোনও হিসাব নেই। এই দলে বহু পাখি রয়েছে। আমুর বাজ (আমুর ফ্যালকন) যার অন্যতম। বাজ প্রজাতির মধ্যে এরা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের। পোকামাকড় খায়। ডানায় রঙের নকশা। ২০১২ সালে সেটি বিশ্বের বিপন্ন পাখির লাল তালিকাভুক্ত হয়।

pix of flying amur falcon
amur falcon

আমুরের দল পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি দেয় প্রতি বছর। হাজার হাজার আমুর একযোগে আকাশে কালো ছায়া তৈরি করে পেরিয়ে যায় মাইলের পর মাইল। চোরাশিকারিরা ওঁত পেতে থাকে। আমুরের দল কোথাও নামলেই পোয়া বারো। কত যে আমুর চোরাশিকারির কবলে পড়ে তাঁর হিসাব নেই। ভারতের নাগাল্যান্ডে আগে এমন বহু বাজকে প্রাণ দিতে হয়েছে শিকারির হাতে।

আমুরের দল প্রতি বছর মঙ্গোলিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। মাঝে নাগাল্যান্ডের দয়াং উপত্যকায় কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম করতে নামে। সেই সুযোগে স্থানীয় নাগা, ওখা ও পাংতি উপজাতির মানুষেরা প্রতি বছর হাজার হাজার আমুর শিকার করতেন। বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যরা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে আমুর শিকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালান। উপজাতিরা সচেতন হন। গ্রামসভা সিদ্ধান্ত নেয়, আমুর শিকার করলে শিকারিকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। গত পাঁচ বছরে আমুর শিকারের ঘটনা একেবারেই ঘটেনি বললেই চলে।

আমুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিভিন্ন দেশ। আমুরের দলের গতিবিধি নজরে রাখার জন্য তাই সচেষ্ট অনেকেই। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর নাগাল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনটি আমুরকে ধরে তাদের পিঠে স্যাটেলাইট ট্রাকার যন্ত্র বেঁধে দেওয়া হয়। স্থানীয় উপজাতির নামে তাদের নাম দেওয়া হয় নাগা, ওখা ও পাংতি। তারা চলে যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। মাস পাঁচেক সেখানে থাকার পরে নাগা ও পাংতি গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, বাংলাদেশ, মেঘালয়, অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে ফিরে যায় মঙ্গোলিয়ায়। এক বছর পরে ২০১৪ সালের অক্টোবরে মঙ্গোলিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার পথে তারা ফের চলে আসে নাগাল্যান্ডের দয়াং উপত্যকায়। যদিও বিজ্ঞানীরা তাদের চিনতে পারেননি। কি করেই বা পারবেন! কয়েক লক্ষ বাজের মধ্যে কিভাবেই বা আলাদা করা সম্ভব! তবে স্যাটেলাইট ট্রাকার জানায়, লক্ষ লক্ষ বাজের মাঝেই রয়েছে নাগা ও পাংতি। কিন্তু ফেরেনি ওখা। কোথায় গেল সে? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন, ওখার স্যাটেলাইট ট্রাকার স্থির হয়ে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি শহরে। হয় সে মারা গিয়েছে, অথবা কোনও ভাবে স্যাটেলাইট ট্রাকারটি খুলে পড়ে গিয়েছে।

এ’বছর ৩১ অক্টোবর, ১ নভেম্বর মণিপুরের তামেংলং জেলায় ৫ টি আমুরের পিঠে সৌর ব্যাটারি চালিত স্যাটেলাইট ট্রাকার বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ২ নভেম্বর থেকে ফালং ও পুচিং নামের দুই বাজের ট্রাকারের কাছ থেকে সিগন্যাল মিলছে না। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, চোরাশিকারিদের হাতে মারা পড়েছে সে’দুটি। তবে ১৯ নভেম্বর চিউলন নামের বাজের ট্রাকার থেকে পাওয়া সিগন্যাল বলছে সে এখন উড়ছে আরব সাগরের উপর দিয়ে। মণিপুর থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল ১২ নভেম্বর। উত্তরপূর্ব ত্রিপুরায় একরাত কাটিয়ে ১৪ নভেম্বর থেকে একটানা উড়ে চলেছে সে। দক্ষিণভারত হয়ে গোয়া-কর্ণাটক সীমান্ত পেরিয়ে ১৭ নভেম্বর সকালে আরব সাগরের আকাশে পৌঁছায়। চারদিনে সে তিন হাজার কিমি পেরিয়ে গিয়েছে। গন্তব্য আফ্রিকা। তবে চিউলনের গতিপ্রকৃতি দেখে বিজ্ঞানীদের ধারণা, সে সোমালিয়া যাচ্ছে।

চিউলন যেখানে হাজার হাজার কিমি পেরিয়ে গেল, বারাক ও ইরাং নামের দুটি বাজ কিন্তু এখনও তামেংলংয়ের আশপাশেই রয়েছে। যদিও তারা মণিপুরে আসে চিউলনদের দলের অনেক পরে। চিউলনদের দলটি এসেছিল সবার প্রথমে, ১৭ অক্টোবর নাগাদ। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর মণিপুর ও তামেংলং নামের দুটি বাজের পিঠে ট্রাকার বেঁধে ছাড়া হয়েছিল। চারদিনের মধ্যে চোরাশিকারিদের হাতে মারা পড়ে মণিপুর। তামেংলং আরব সাগর পেরিয়ে যায়। তবে ১৪ ডিসেম্বর থেকে আর কোনও সিগন্যাল আসেনি তামেংলংয়ের ট্রাকার থেকে। শেষবার তাকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, জাম্বিয়ার উত্তর লুয়াঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে। সত্যি, এই পাখিদের বিচিত্র এই গতিপ্রকৃতির কথা ভাবতে বসলেই বিস্ময়ে মন ভরে যায়। বছরের পর বছর ধরে তারা হাজার হাজার কিমি উড়ে পৌঁছায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। কয়েক মাস পরে আবার ফিরে আসে আগের জায়গায়। পরের বছর সেই নির্দিষ্ট সময়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। আবার হাজার হাজার কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছায় আগের বারে যাওয়া সেই আগের জায়গায়। পথে কত বাধা-বিঘ্ন। চোরাশিকারি থেকে খাবারের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, কত কি। তবু যুগ যুগ ধরে ওদের উড়ে চলার কোনও বিরাম নেই!

Photo courtesy: Wikimedia Commons

Leave a Reply