ভূত চতুর্দশীর রাতে বিকল হল ইনভার্টার ।বিদ্যুৎ দফতর আগেই নিয়ম করে রক্ষণাবেক্ষণ করেছে বৈদ্যুতিক তারগুলির । কী ভাবে কে জানে হঠাৎ ভূত চতুর্দশীর রাতে লোডশেডিং হল, আমাদের পাড়ায়। বিদ্যুৎ দফতরের অফিসে ফোন করে জানা গেল , আমাদের পাড়ার ট্রান্সফরমারটি বিকল হওয়ার বিদ্যুত্ বিভ্রাট সময় লাগবে কারেন্ট আসতে। এদিকে কোনও এক অজানা কারণে বাড়ির ইনভার্টার ও জবাব দিল ।
সন্ধের আগে থেকেই আমাদের পাড়ার আলোয় আলোকিত হয়েছিল কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় চার দিকে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল কিছুক্ষণ আগেই টুনি লাইটের আলোয় চারিদিক যেন দিনের আলোর মতো ঝলমল করছিল আর বিদ্যুত্ বিভ্রাট গোটা পাড়ায় নেমে এল এক নৈশ বিভীষিকা ।আমাদের বাড়িতেও এলইডি আলোর বাল্ব জ্বলছিল কিন্তু এখন অন্ধকার, আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল ।
আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে মোমবাতি হ্যরিকেন কিছুই নেই । কিন্তু আজ অন্য ব্যপারে। ভূত চতুর্দশী হওয়ার দরুন সন্ধেবেলায় আমার স্ত্রী তুতুল অার আমার মা গুনে গুনে ১৪টি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। আজ পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশে এই প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে । সে যাই হোক আজ সন্ধে আখেরে লাভ ই হল।এই অন্ধকার কাটাতে তুতুল প্রদীপে তেল ঢেলে সেগুলোই জ্বালিয়ে আনল বেশ কয়েকটা। অমাবস্যার রাত তার ওপর ভূত চতুর্দশী কেমন যেন আলোআঁধারিতে গা ছমছম ব্যাপার । সে দিন আবার আকাশ মেঘলা ছিল সঙ্গে হালকা বাতাস বইছে তাই মোমবাতি প্রদীপের আলো মাঝে মাঝেই দুলে উঠছে। বাড়িতে কেবল চারজন সদস্য আমরা আমি তুতুল আর আমাদের এক ছেলে পাপন আর মেয়ে তুলি কিন্তু কালীপুজো উপলক্ষে আমার বাবা মা এসেছেন। আর আছে আমাদের হুলো গাবলু। এই আমাদের সংসার। আমার বাবা-মা গ্রামের বাড়ির খোলা সবুজ ঘেরা ছেড়ে শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে এখনও অভ্যস্ত না হলেও উত্সবের যেসব দিনগুলোতে আমরা যেতে পারি না তারা আসেন আমাদের কাছে ।
এই ঘন অন্ধকারে বছর পনেরোর পাপন আর সদ্য বারো বছরে পা দেওয়ার তুমি কেমন করে না জানি মোবাইল ছেড়ে দাদুর স্বামীর কাছে বায়না ধরেছে গল্প শোনার জন্য। পরীক্ষা শেষ তায় আবার ছুটির মেজাজ । এই জমাট অন্ধকারে ভুতের গল্পই বলতে এমনটাই তাঁদের আবদার তুলি বরাবরই জালমির বেশ ন্যাওটা কিন্তু পাপন সে যে কী ভাবে মোবাইল ছেড়ে গল্পের সরে মজেছে কে জানে ? ওদের বায়নায় আমরাও স্বামী করেও আজকে ভূত দোষী দিনে গল্পের বিষয় ভূত ছাড়া কিছু হতেই পারে না বাবা পঁচাশির কোঠায় পা দিলেও এখনও সটান ছিপছিপে তবে স্কুলগুলো সব সাদা হয়েছে একটা অন্ধকার কেমন করে যেন কাছের মানুষগুলোকে আরও কাছের করে তুলেছেন প্রদীপের আলোয় বাবার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি দেখলাম বাবা কোনও রকম ভনিতা না করেই শুরু করলেন তার গল্প সালটা উনিশশ সত্তর হবে রাজনৈতিক ভাবে চারিদিকে কেমন যেন ডামাডোল চলছে । শহরের ফুল কি কিছু গ্রামেও এসে পড়েছে। স্কুলের ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে চোখে সে আগুন দেখেছি কখনও! তাঁদের বুঝিয়েছি ফল যে হয়েছে তা বলব না। কিন্তু ছাত্ররাই যে আমার প্রাণ ছিল ।এক দিন সন্ধেবেলায় ১১ ১২ ক্লাসের ছেলেদের মা বাবা এসে বললে,” ছেলেরা একদম পড়াশুনা করছে না । আপনি একটু দেখুন এদের। ” আমি আর কি দেখব! তবে এটা ঠিক সেই সময় ছেলেরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের মান্য করত। কিছু বললে শুনত। টিউশান আগে কখনও করিনি কিন্তু বাবা মা অভিভাবকদের আবদার ফেলে দিতে পারলাম না।
আট মাইল রাস্তা সাইকেল করে রোজ স্কুল যাই। স্কুলের ছাত্রদের প্রাণ দিয়ে পড়িয়েছি তখনও এমন টিউটর লাগত না কারণ স্কুলে যা পড়ানো হতো তাতেই বাড়িতে এসে পড়লে ভাল রেজাল্ট করতে পারত ছেলে মেয়েরা। যা হোক ওই অভিভাবকদের কথায় শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম । স্কুল থেকে আসার পথে ঢুলুই গ্রাম নামে একটি ছোট্ট গ্রাম। সেখানে রায়পাড়ায় পরানো হতে হবে সুবল রায়ের বাড়িতে পাড়ানো হবে। ছেলে এগারো ক্লাসে পড়ে পড়াশোনায় ভালো হলেও ক্লাস ক্লাসে কেমন একটা বেয়ারা হয়ে উঠেছে পড়াশোনা করছে না তাই সুবলবাবু আগ্রহ করে তাঁর বাড়িতে পড়ার ব্যবস্থা করলেন। আশেপাশের ব্র্যান্ড থেকেও বেশ কয়েকজন এসে জড়ো হল খবর পেয়ে সুবাহু না করলেন না বাইরের বসার একটা ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ হল ভুলই গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামে আসতে সময় লাগল আধঘণ্টার স্কুল থেকে ফেরার পথে পেরিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরতাম ।
এবার থেমে বাবা আমাকে সম্বোধন করে বললেন জানিস রাজু ,তুই তখন হস্টেলে আর চৈতালি মানে আমার বোন নাইনে পড়ে । বেশ ভালই চলছিল । শীতে একটু সমস্যা হতো বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। ওই দুই বছর বেশ কষ্টই হয়েছিল । তার পর অবশ্য আর টিউশন পড়ায় নি।
ধুলোয় গ্রামটা বেশ কয়েক শ বছরের পুরনো গ্রাম বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল সেখানকার পুরনো ঘরবাড়ি মন্দির দেখলে সেটা বোঝা যেত কৃষি নির্ভর এই গ্রামে বেশ ভাগ মানুষই ছিল চাষের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু নতুন প্রজন্ম একে একে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছিল । ১৯৭২ বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল । এই গ্রামের তখনও বহু মানুষ উঠে গিয়েছিল শহরে। তাই গ্রামের বাড়ি গুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও পাড়াগুলোতে লোকজন বেশি থাকত না বেশির ভাগ বাড়ি ফাঁকা পড়ে ছিল কিন্তু মানুষজন একেবারে নেই তা নয়। জনসংখ্যা ভালোই ছিল, নিয়ম করে তাঁরা চায়ের দোকানে চন্ডিমন্ডপে আড্ডা দিত যেমন তেমনি একে অপরের খোঁজ খবর নিতো অন্যের দুঃখে বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ত । আমাকে সবাই অনেকেই চিনত স্কুলে পড়ানোর জেরে পড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই পুরনো ছাত্রদের মধ্যে কারও না কারও সঙ্গে দেখা হত তারাই আমাকে গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে যেত গল্প করতে করতে রাস্তাটা কী ভাবে পেরিয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না ।
এমনই এক শীতের সন্ধ্যায় স্কুল সেরে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরছি । শীতের রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আমাদের গ্রামে আলো এলেও তখন সব গ্রামে আলো আসেনি। কিন্তু ধুলোয় গ্রামে হ্যারিকেনের আলোয় ব্যবহার ছিল এই গ্রামেও আরও আসেনি তখনও ইলেকট্রিক বলগুলো বসেছে ঠিকই কিন্তু বিদ্যুত্ সংযোগ হয়নি তখনও ।
সঙ্গে আমার সব সময় একটি লম্ফ থাকত। দরকার হলে জ্বালিয়ে সাইকেলে ঝুলিয়ে দিতাম। শীতের সন্ধে চারদিকে কুয়াশার চাদর। পথঘাট একেবারে ফাঁকা । গ্রামের মাঝেই মুদীর দোকানে। সেখানে টিএম টিম করে আলো জ্বলছে। কয়েকজন বসে কথাবার্তা বলছেন। আমি সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের সঙ্গেও আমার ও কথা হলো, কুশল বিনিময় হল। তার পর এগিয়ে যাচ্ছি। কান্নার কাজ চলছে বিভিন্ন বাড়িতে পাতার জ্বালানির গন্ধ বেরোচ্ছে কিন্তু সব বাড়ি চালনা দরজা বন্ধ গ্রাম শেষ করে পড়লাম মোরামের মেন রাস্তায় পথে কেউ নেই চারদিকে থমথম ভাব এখান থেকে বাড়ি ফিরতে আরও মিনিট কুড়ি তো লাগবেই অন্য দিন সাতটার মধ্যে পড়ানো হয়ে যায় সে দিন পড়াতে পড়াতে খেয়াল না থাকায় একটু দেরি হয়ে গেল।কয়েক দিন আগে অমাবস্যার পেরিয়েছে। এখনও চাঁদ আকাশের নেই। চারিদিক অন্ধকার । লম্ফট টিম টিম করে চারপাশে আলো ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। হঠাত্ সাইকেলের চেন পড়ে গেল। মনটা তখন একটু বিগড়ে গেল। সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ,স্কুলে সাতটা ক্লাস নিয়ে ,টিউশন করে বাড়ি ফিরছেন শরীরটা তখন বেশ ক্লান্ত । তার মধ্যে এই সব ব্যাপার লম্ফে আলোয় চেনটা লাগানো হয়েছে হঠাত্ দেখি সামনে কিছু দূরে একটা প্রকাণ্ড দালান । আগে এখানে এটাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না । কোথা থেকে এল এটা। এমনটা ভাবছি, তারই মধ্যে দেখি ডলার দালানের সামনে কে যেন বসে আছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । আমার কাছে লম্ফের ওইটুকু আলো । হাত দূরের পরে আর কিছুই দেখা যায় না । শুধু বুঝতে পারছি কেউ একজন বসে আছে। গা একটু ভারী হয়ে উঠছে। পা যেন সরছে না ।সাইকেলটা যেন কয়েক মন ওজনের হয়ে গেছে । সেই ছায়ামূর্তি নড়ে না চড়ে না । শুধু বসে আছে । শীতের রাত তখন প্রায় টা হবে। চারিদিকে কেউ নেই ।এত রাতে কেউ কেন বাইরে বসে থাকবে? হাত ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে !টুপি মাফলার গায়ে কম্বলের কোর্ট ,শালের তলা দিয়ে ক্রমশ টপ টপ করে ঘাম পড়ছে; কেমন অসহায় রাখছেন নিজেকে কিন্তু কিছু করার নেই ।
ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কে যেন আমায় ডাকল। ‘ স্যার।’ পিছন ফিরে দেখি তবে আমার ছাত্র বুকে একটু বল পেলাম । তপেন আমাকে বলল,’ চলুন স্যার আপনাকে এগিয়ে দিই’। আমি বললাম তুমি কোথা থেকে এলে। সে বলল,’ এই তো ! ‘ আর কথা হল না । দু জনে হাঁটতে শুরু করলাম ।কোথাও কথা বলতে বলতে পথ চলছে শুধু সেই দালানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর চোখে দেখলাম সেই মহিলা তখনও বসে আছে তপেন কথা বলতে বলতেই চলল। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তপনের সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন গ্রামে পৌঁছেছে খেয়াল নেই ।আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল ।আমাদের গ্রামে ঢোকার মুখে তপেন চলে গেল বাড়িতে আসার কথা বললেও জানাল অন্য দিন আসবে তপেন চলে গেল। সাইকেল চালিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম সামনের দরজায় দেখি তোমাদের ঠাকমা দাঁড়িয়ে । বাড়ি ফিরতে সে দিন রাত এগারোটা হয়েছিল। সে দিন রাত থেকে আমার প্রচণ্ড জ্বর। আমার কোনও জ্ঞান ছিল না তিন চার দিন । ওষুধ খেয়ে অাস্তে আস্তে সেরে উঠছি। ৫ দিন কেটে গেছে হতে। সকালে যায় চাদর দিয়ে ওঠানে বসে গরম গরম চা খাচ্ছি। তখন সুবল রায় বাড়িতে এল , সঙ্গে ছিল আমাদের স্কুলের দুই শিক্ষক দাস বাবু ও মুখার্জি বাবু ।
৫ দিন পর সূর্যের আলোয় বসে মনটা আমার চনমনে হয়ে উঠেছে । প্রথম কথা বলতে শুরু করেছি । সুবল আমাকে জানতে চাইল ,সে দিন এত দেরি হয়েছিল কেন? কেনই বা আমার জ্বর হল ? আমি একটু করে সব খুলে বললাম । আমি তো খুব ভয় পেয়েছিলাম, সেটাও থেকে জানালাম। পৌষের ঠান্ডায় ঘেমে, ঘাম গায়ে শুকিয়েছে । তাই এত জ্বর । আমি বললাম, তপেন আমায় পৌঁছে দিয়েছিল তাই ! নইলে ওখানেই মরে পড়ে থাকতাম ! মুখার্জি বাবু যেন একটু চমকে উঠলেন, বললেন কোন তপেন? তপেন চাটুজ্জে নাকি? আমি বললাম সেই তো , সকলে মুখ চাওয়া চাই করল, আমার কেমন একটা সন্দেহ হতে শুরু করল। জিজ্ঞাসা করলে , সুবলরা তাড়াতাড়ি বিদায় সেরে চলে গেল। তার পর বেশ কয়েক দিন পর আমি সম্পূর্ণ সেরে উঠলাম ,তারপর জানতে পেরেছিলাম তপেন দুই জায়গাতেই মারা গিয়েছিল ।দু বছর আগে ওই রাস্তার পাশে । রাস্তার পাশে যেখানে ওই দালান যা ছিল সেখানেই মৃত দেহ টি পাওয়া যায়।গ্রামের মানুষেরা ওই রাস্তায় যাতায়াত খুব বেশি করে না ধুলোয় গ্রাম প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো গ্রাম বহু বছর আগে ওই জায়গায় সত্যিই একটা দালান বাড়ি ছিল বোস পরিবারের ।কলেরা মহামারীতে গ্রামের বহু মানুষ মারা যায়। বোসবাড়ি ও বাড়ির পুরুষেরা কলেরায় মারা গিয়েছিল। শুধু বাড়ির গিন্নি বহু বছর বেঁচেছিলেন। শেষের দিকটায় তিনি উন্মাদ হয়ে গেছিলেন। সারা দিন বাড়ির সামনে দাওয়ায় বসে থাকতেন । ওই ভাবেই দিয়ে দেখি মারা গিয়েছিলেন ।আজও ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ তাকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখতে পায়। যে দেখে সে আর ফেরে না ! তবে কি তপেন ওই ভাবে মারা গিয়েছিল ।সে কি তা হলে স্যারকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল সেদিন! আজও ভাবলে গাঁয়ে কাঁটা দেয়। বাবা বললেন ।
ঠিক তখনই আলো জ্বলে উঠল কিন্তু সবাই তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে । বাড়িতে তখনও নিস্তব্ধতা!!!
+ There are no comments
Add yours