বনকাটির মুখুজ্জে পরিবার

মধ্য রাঢ় অঞ্চল এক সময় ছিল জঙ্গল মহলের অন্তর্ভুক্ত। সেন রাজারা গঙ্গা বিধৌত সমভূমিতে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার আগে এই রাঢ় অঞ্চলে বিস্তৃীর্ণ এলাকায় কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন। এখানকার জঙ্গল, মাটি, পথ-ঘাট ছিল সেন রাজাদের পরিচিত। তাই এই এলাকার আর এক নাম সেনপাহাড়ী। এই এলাকার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। আড়াইশো থেকে তিনশো বছর আগে এই এলাকা বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল ব্যবসা বাণিজ্যে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের বাস ছিল। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ পরিবারের অনেকেই গালা, কাঠকয়লা, গন্ধদ্রব্য, মশলাপাতি ইত্যাদির ব্যবসা করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এসবের মধ্যে গালার গহনার চাহিদা ছিল খুব। সেই সময়ের এই অর্থশালী পরিবারগুলো পাকা দালান গড়ে তুলেছিলেন।

অনেক মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। গ্রামের নাম বনকাটি। সেখানে শিবমন্দির গড়েছিলেন তাঁরা। আজও আছে সে সব নিদর্শন। সময়ের সঙ্গে সেই জৌলুস আর নেই। বহু পরিবার উঠে গেছে অন্য গ্রামে। আবার অনেকেই এখনও রয়ে গেছে এই গ্রামে। তাদের মধ্যে অন্যতম মুখোপাধ্যায় পরিবার। মেয়ের ঘরের নাতি শিবপ্রসাদ মামা বাড়িতেই বড় হয়েছে। দাদু ব্রজকিশোর মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাসভারী মানুষ। পাশের গ্রামের জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কাজেই দাদুর কড়া নজরে মানুষ শিবপ্রসাদ। লেখাপড়ায় ভালো শিবু স্কুলে ছুটির দিনে গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো। দাদুর কাছে গ্রামের ইতিহাস শুনেই বড় হয়েছে। জমির আলে, পুকুর পাড়ে, তালগাছের তলায়, নদীর ধারে কত সময় যে সে কাটিয়েছে! এই গ্রাম ছেড়ে তার আর ফেরা হয়নি। দুর্গাপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নেয় শিবু।

মামা রাজেন্দ্র ডাক্তারি পড়তে লন্ডনে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি। মাঝেমধ্যে আসেন। ফলে দাদুর পূর্ব পুরুষের ফেলে যাওয়া দুশো বছরের দালান বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল শিবু। তার পর পেরিয়ে গেছে বহু বছর। শিবপ্রসাদ চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাঁর ছেলে দিল্লীতে চাকরি করে। বাড়িতে কমই আসে। এখন বুড়ো-বুড়ি এই বাড়ির নিচের দুটো ঘর ব্যবহারযোগ্য করে নিয়েছেন। বলা যায়, ছেলে সমৃদ্ধই দায়িত্ব নিয়ে আধুনিক আদলে বদলে দিয়েছে পুরনো ঘরদুটিকে। যদিও সবটা হয় নি। পুরানো দিনের বাড়ি। অনেক জায়গায় ভেঙে যাচ্ছে। কিছুটা থাকার উপযোগী করে নেওয়া  হয়েছে। রান্নাঘর বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে বারান্দার দুপাশে।

শিবুবাবু এখন দিনভর গ্রামের দুস্থ বাচ্চাদের পড়ান। গ্রামের বিভিন্ন গল্প শোনান। সকাল-সন্ধ্যা নারায়ণের নিত্যসেবা করেন। দাদুই তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছিলেন। এবং পুজোর বিশেষ পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। পিতলের সিংহাসন চারবার বাঁদিকে ঘোরাতে হবে তারপর সিংহাসনে নারায়ণের মূর্তি শুইয়ে দিতে হবে। প্রতিদিন এভাবেই নারায়ণকে ঘুম পাড়িয়ে, সিংহাসন আবার ডান দিকে ঘুরিয়ে যথাস্থানে রাখা হয়। এই ভাবেই পুজোর পদ্ধতি দাদু শিখিয়ে গিয়েছেন শিবপ্রসাদকে।

বাড়ির একপাশে দুর্গাদালান। তার পাশ ঘেঁসে মন্দির। অষ্টধাতুর সিংহাসনে নারায়ণ অধিষ্ঠান করেন। মন্দিরটি এক কালে সুসজ্জিত থাকলেও এখন ভগ্নদশা। সেই মন্দিরেরই বর্তমান সেবাইত শিবপ্রসাদ। বেশ চলছিল। পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বিছানায় লেপের তলায় বসে টিভি দেখছেন শিবপ্রসাদ আর তার স্ত্রী মনিকা। রাত তখন সাড়ে ১০ টা হবে। গ্রামে মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। উৎসব অনুষ্ঠানে মানুষের সমাগম হলেও বছরের বাকি সময়টা থাকে একেবারে শুনশান। আর এই বাড়ির চারপাশে কোনও বাড়ি নেই। একটু দুরে বাঁড়ুজ্যেদের কয়েকটা বাড়ি রয়েছে।

টিভি দেখা শেষ করে সবে আলো নিভিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিবপ্রসাদ। এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। এত রাতে কে আসতে পারে ভেবে চিন্তায় পড়লেন শিবপ্রসাদ। পুরনো দিনের লোহার দরজা, ভাঙা সহজ নয়। কর্তা-গিন্নি একে অপরের চোখ চাওয়া চাওয়ি করছেন। তাঁরা নিশ্চিত, ডাকাত, সন্দেহ নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা হাতে সদর দরজা খুললেন শিবপ্রসাদ। কিন্তু একি!  কেউ কোথাও নেই। তবে কি ভুল শুনেছেন। পাশে এসে দাঁড়ান মনিকা। তিনিও অবাক। কেউ নেই।

দরজা বন্ধ করতে যাবেন, এমন সময় তাঁরা দেখলেন, কে যেন লাঠি ভর করে সামনের দিকে ঝুঁকে বাড়ির পিছন দিক থেকে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই দু’জনের চোখে বিস্ময় খেলে গেল। শিবপ্রসাদের মামা রাজেন্দ্র এসেছেন। শিবপ্রসাদ এগিয়ে গেলেন। মামা যে, এসো এসো! ৮৮ বছরের বৃদ্ধ রাজেন্দ্র মৃদু হাসলেন। শিবপ্রসাদ বললেন, এত রাত হল কি করে? আগে জানালে তো গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। তুমি একা এত রাতে, কিছু সমস্যা হলে কি হতো? এমন পর পর প্রশ্ন করে চললেন শিবপ্রসাদ।

মনিকা বললেন, আগে ঘরে আসুন। হাত পা ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করুন। পরে বাকি কথা হবে। সদর দরজা দিয়ে রাজেন্দ্র ঢুকতে ঢুকতে বললেন, না এখন আর খাব না। দাওয়ায় বসে একটু গল্প করি। রাত তো বেশী বাকি নেই। অনেক কথা বলতে শুরু করলেন রাজেন্দ্র। ছোট বেলার কথা। বিদেশের কথা। তিনি জানালেন, এখানকার জন্য মন খারাপ করছিল। তাই চলে এসেছেন। বললেন, তোমাদের মামী গত হাওয়ার পর বড় একা লাগে। তাই ভাবছি বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবো।

শিবপ্রসাদ খুশী হয়ে বললেন, দারুণ ব্যাপার! থাকো থাকো। এত বড় বাড়ি, কোনও অসুবিধা নেই। শীতের রাত। ভোর ৩ টে। ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। কম্বল জড়িয়ে নিলেন শিবপ্রসাদ। রাজেন্দ্রবাবু বললেন, শোন শিবু তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। নারায়ণের সিংহাসনের নীচে একটা বাক্স আছে। ওটা মাটি থেকে তুলতে হবে। ওটাতে মুখোপাধ্যায় বাড়ির সম্ভার আছে। আর সেটা, আমি তোকে দিলাম। শিবপ্রসাদ বিস্ময় নিয়ে বললেন, কোথায়? আমি জানি না তো! আর সম্পত্তির কথাই যদি বলো, তা আমি কেন? তোমার ছেলের ওটা পাওয়া উচিত। রাজেন্দ্র কথা বললেন না। শুধু মাথা নাড়লেন।

রাজেন্দ্র শুরু করলেন। পিতলের সিংহাসন চারবার বাঁদিকে ঘোরাতে হবে। তারপর সিংহাসনে নারায়ণের মূর্তি শুইয়ে দিতে হবে। এরপর ডান দিকে সিংহাসন পাঁচবার ঘোরালেই বাক্স উঠে আসবে। সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে থাকাকালীন মুখোপাধ্যায় বাড়ির নবীবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নবাবের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। নবাবের কোনও একজন স্ত্রী অসুস্থ হলে তিনি তাঁকে ওষুধ দেন। তাতে তাঁর স্ত্রী সেরে ওঠেন। তখন এক বাক্স স্বর্ণমুদ্রা ও ৫০ বিঘা জমি উপহার দেন। পরে এই বংশের ছেলেরা ব্যবসায় মন দেয়।

শিবপ্রসাদ এত গল্প দাদুর কাছে শুনেছেন কিন্তু এটা কখনও শোনেননি। রাজেন্দ্র আবার বলেন, বাবা মারা যাওয়ার আগে একটি পুঁথি আমাকে দেন, তা থেকেই এত কথা আমি জেনেছি। শিবপ্রসাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। মনিকা বললেন, অনেক হয়েছে এবার ঘুমাবেন চলুন। আমি বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে দিয়েছি। এরপর সবাই মিলে শুতে গেল।  

শিবপ্রসাদ দুচোখের পাতা এক করতে পারছেন না। নানান চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সকাল হওয়ার আগেই উঠে পড়লেন শিবপ্রসাদ। গরম পোশাক জড়িয়ে বাইরে এলেন। চারিদিক নিস্তব্ধ। পাশের ঘরে উঁকি দিলেন, মামাকে দেখার জন্য। বিছানার দিকে তাকিয়ে অবাক। বিছানায় কেউ নেই। বিছানা ফাঁকা। ঠিক এমন সময় দরজায় জোরে জোরে কড়াঘাত। দরজা খুলে দেখেন, পুলিশ অফিসার মিস্টার বসাক দাঁড়িয়ে। মিস্টার বসাক বললেন, কাল রাতে একটি অ্যকসিডেন্ট হয়েছে। ব্যাগ থেকে আপনার বাড়ির ঠিকানা পেলাম। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, আপনার মামা ও তাঁর ছেলে। দুজনেই ঘটনাস্থলে মারা গিয়েছেন। আপনাকে একবার যেতে হবে সনাক্তকরণের জন্য।

বসাকবাবুর কথা কানে যাচ্ছে না শিবপ্রসাদের। মনিকাকে ডাকতে চাইছেন তিনি। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তবু গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। রাতে তাহলে এল কে? চারিদিক অন্ধকার। মাথা ঘুরে পরে গেলেন শিবপ্রসাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *