বিজনপুর

অর্পিতা মজুমদার

বিজনপুর এক অজ গাঁ। এই একবিংশ শতাব্দীতেও কখনও কখনও ইলেকট্রিক কানেকশন টানা ছয়দিন ধরে থাকে না। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- লোডশেডিং লেগেই থাকে। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। এই দু’দিনই সারা সপ্তাহের সমস্ত আনাজপাতি, কাপড়-জামা, চটি সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে রাখতে হয়। কারণ ওই হাট ছাড়া আর কোনও দোকান নেই গ্রামে।

এমন একটা গ্রামে আমার একমাত্র পিসিমার বাস। কোনরকম অসুবিধা ছাড়াই জীবনের বেশীর ভাগ সময়টা এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সুজলা সুফলা এই গ্রাম হানাবাড়ির জন্য কুখ্যাত। গ্রামের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রায়চৌধুরীদের বাগান বাড়ি। এই বাড়ির আরও কি্ছুটা দক্ষিণে বিশাল বিল। বর্ষাকালে জল বাগান বাড়ির গা পর্যন্ত চলে আসে। এককালে বিখ্যাত সব বেনারসী বাইজিরা গান শুনিয়ে যেত রায়চৌধু্রী জমিদারবাবুদের বাড়িতে। এই জমিদারদের পঞ্চম পুরুষ পুরুষোত্তম রায়চৌধুরী। শাসনে বেশ নাম করেছিলেন। কিন্তু বদ গুণ বলতে, রাতের পর রাত তিনি নামি দামী বাইজিদের গান শুনেই সময় কাটাতেন। এই বদ গুণই এই পরিবারের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল। সঙ্গে এনেছিল নানান ভৌতিক কাহিনীর সূত্র।

এক বর্ষাকালে রাতে ঝমঝম নাগাড়ে বৃষ্টি চলছে। বিলে তখন কানায় কানায় জল। ব্যাঙের ডাকে বিজনপুর গ্রাম মুখরিত। শোনা যায়, সেবার টানা ৪ মাস ধরে লখনউ থেকে মুন্নিবাঈ এসে বাগান বাড়িতে আসর জমিয়ে ছিল। সেই বর্ষার রাতে যে বাগান বাড়িতে কি হয়েছিল কেউ জানে না। শুধু মধ্যরাতের আগুনের লেলিহান শিখা গোটা গ্রামের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। পরের দিন জমিদার বাড়িতেও রাণীর নিথর দেহ মিলেছিল নিজের বিছানায়। জমিদারের পোড়া দেহটা মিলেছিল বাগান বাড়ির নাচ মহলে। সেখানে মুন্নিবাঈয়ের দেহও মিলেছিল। কেউ বলে ঝাড় লন্ঠন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ বলে রাণীর অভিশাপে আগুন লেগেছিল। আসল কারণ আজও অজানা। তারপর জমিদার বাড়িতে কেউ থাকতে পারেনি। একে একে মৃত্যু মিছিল নেমেছিল সেখানে। দাস দাসীরা পালিয়েছিল। জ্ঞাতি গুষ্টিরা সেখানের বাস ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। যে কয়েকজন বেঁচে ছিল কেউ ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে কেউ বা বিলের জলে ডুবে মরেছে। তবে গ্রামের উপর কোনও অভিশাপ নেমে আসেনি।

গ্রামের জীবন চলেছে নিজের খেয়ালে। তবে চোর চাপটারা দিনের বেলাতেও যদি জমিদার বাড়ির ইটে হাত দেয়, তারা নুপুরের শব্দ শুনতে পায়। রাতে গেলে শুনতে পায় কারা যেন আর্তনাদ করছে। তাই ভেঙে গেলেও জমিদার বাড়ি আছে জমিদার বাড়িতেই।

আমার পিসিমা ৩৫ বছর এই গ্রামে আছেন। তাঁদের বহু আত্মীয় স্বজন সকলে আছেন। আমি ছোট বেলায় বহুবার গেছি। শুনেছি অদ্ভুতুড়ে নানান গল্প। দিনের বেলা বাবার হাত ধরে বহুদূর থেকে দেখেছি জমিদার বাড়ির বাগান। কাছে কখনও যাইনি।

কয়েকদিন আগে আমি কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। হোস্টেলে যাওয়ার আগে পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সঙ্গে আমার ছোটোবেলার বন্ধু অসিত। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। সায়েন্স এগিয়ে চলেছে দ্রুততার সঙ্গে। স্টেমসেলের হাত ধরে মৃত্যুকেও জয় করার পথে মানুষ। কিন্তু ইতিহাস। সেও তো নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় প্রাচীন স্থাপত্যের ফাঁকে। গ্রামীন বিশ্বাস সেও তো ফেলে দেওয়ার নয়!

আমরা যখন বিজনপুরে পৌঁছালাম তখন দুপুর। বৃষ্টিতে পিচের রাস্তার ওপরও কাদা প্যাচ প্যাচ করছে। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট তুলে পিসিমার বাড়ি ঢুকলাম। লোডশেডিং চলছে। কিন্তু ঠাণ্ডা আমেজ রয়েছে। নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনো ঝমঝম কখনো রিমঝিম। দুপুরে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, পুকুরের মাছ ভাজা আর চাটনী দিয়ে আহার সারলাম। পিসতুতো দাদারা বাইরে চাকরি করে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু পিসি আর পিসেমশাই থাকেন। খাওয়ার পর দুই বন্ধু পিসেমশাইয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। চাষে ফলন ভালো হলেও চাষের প্রতি নতুন প্রজন্মের টান কমছে, ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলোচনা হল।

কখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে খেয়াল করিনি। শাঁখের শব্দে খেয়াল হল। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। চারিদিকে এক নিস্তব্ধতা। আর ব্যাঙের ডাক। মন্দ লাগছিল না। কি করি বুঝতে পারছি না। ছাতা মাথায় পিসিদের আত্মীয়দের বাড়িগুলো ঘুরে এলাম। কাল দুপুরেই আমরা চলে যাব। তাই দেখা করে এলাম। বৃষ্টি না পড়লে একটু হেঁটে আসা যেত। যা হোক। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে লম্ফ কমিয়ে শুয়ে পড়লাম। এতটা জার্নি করে এসেছি। ক্লান্ত শরীর বিছানা পেতেই চোখ বুজে এল।

রাত কটা হবে জানি না। হঠাৎ চিৎকার, হৈচৈ এর শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি অসিত জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে। ওকে দেখে আমিও ছুটে গেলাম জানলার কাছে। দেখি চৌধুরীদের বাগান বাড়ির দিকে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। আর আর্তনাদের শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা দরজা খুলে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম, পিসেমশাই কে ডাকব বলে। দেখি পিসিমা, পিসেমশাই বাইরে চেয়ারে বসে আছেন লম্ফ জ্বালিয়ে। আমি কিছু বলার আগেই পিসেমশাই বললেন, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে আজকের দিনেই রায়চৌধুরীদের বাড়িতে ঘটেছিল সেই ঘটনা। বহু বছর পেরিয়ে গেছে। তবু এই দিনে গ্রামে অতিথি এলে তারা শুনতে পায় সেই আর্তনাদ। ভয় পেও না সব থেমে গেছে এতক্ষণে। সেজন্যেই আমি আর তোমাদের পিসিমা জেগে আছি। যাতে তোমরা ভয় না পাও।

জানলার কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই তো কিছু নেই! চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল বৃষ্টি পড়ছে ঝিমঝিম করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *