বিপ্লব ‘বিপ্লবী’ হয়ে উঠতে পারেনি কোনও দিনই। তা সরকারি অফিসেই হোক বা দাদার সংসারের জাঁতাকলে। অবশ্য দাদার সংসার ছেড়ে এখন ব্যাচেলার মামার কাছে থাকছে। মামা-ভাগ্নের দিব্য কাটছিল দিন। মামা বারবার অনুরোধ করেছে বিপ্লবকে বিয়ে করবার জন্য। কিন্তু ৩৬ এর বিপ্লব রাজী হয়নি। কারণটা অবশ্য কারও কাছে খোলসা করেনি সে। অনামিকার মুখটা এখনও চোখে ভাসে তার।
সেই ছোটবেলায় পরিচয় মামাবাড়ির পাড়ায়। বিপ্লবের থেকে অনামিকা ৩ বছরের ছোট। গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি এলে দুজনে মিলে কত খেলাই না খেলেছে। কলেজে পড়াকালীন একে অপরকে কবিতার লাইন তুলে কত প্রেমপত্র চালাচালিটাই না করেছে। কিন্তু মায়ের অমতে ব্রাহ্মনের সন্তান হয়ে সাহা বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে পারেনি। তারপর থেকে বিয়ে না করার পণ সে এখনও পালন করে চলেছে।
নিজের নামের প্রতি রাগ হয়েছে খুব। দশ বছর হল বিয়ে হয়েছে অনামিকার। তারপর আর মামাবাড়ি যায়নি বিপ্লব। কোনও কিছুতেই মন বসে না তার। দাদার সংসারে সবজি আনো, এটা আনো, সেটা আনো, করেই জীবন কাটছিল। হঠাৎ একদিন দাদা বিপ্লবকে ডেকে বলল, “বাড়িতে লোকজন এলে ঘরের সমস্যা হয়। তুই তো একা মানুষ। দোতালার চিলেকোঠার ঘরটা কাল পরিস্কার করে দেব। এখন থেকে ওই ঘরেই থাকিস।” একথা শোনার পর আর সেখানে থাকতে ইচ্ছে করেনি বিপ্লবের।
সামান্য কিছুই তার সম্বল। বেশ কয়েকটা বইপত্র আর কয়েকটা জামাকাপড়। সেগুলো গুছিয়ে সোজা মামা বাড়িতেই উঠেছে। মা মারা গেছেন দু’বছর আগে, আর বাবা নেই, সে তো ৫ বছর হয়ে গেল। এই কলকাতা শহরে তার আর কেউ নেই! এদিক ওদিক উদভ্রান্তের মত ঘুরে শেষ পর্যন্ত দত্তপুকুরে মামার কাছেই উঠল। মামা একা মানুষ। অবসর জীবনে ভাগ্নেকে পেয়ে হাতে চাঁদ পেলেন। তারপর সে’ভাবেই চলছিল। অফিস থেকে ফিরে মামার সঙ্গে রাত পর্যন্ত গল্প করে বিপ্লব। রান্নার মাসি অমলা খেতে ডাকলে খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায়। অমলাই সব গুছিয়ে রেখে যায়। পাশের পাড়াতেই তার বাড়ি। সকালে ঠিকে ঝি এসে ঘরদোর পরিস্কার করে রেখে যায়।
এখানে আসা ইস্তক মামার আদরেই দিন কাটছিল বিপ্লবের। শুধু অনামিকাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে বুকটা হু হু করে। তাই সেদিকটা দিয়ে না গিয়ে একটু ঘুরে বাসস্ট্যান্ডে যায়।
ফাল্গুন মাসের প্রথম শুক্রবার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে আছে। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। সকালে রেডি হতে হতে ভেবেছে, এ কোন জীবন যাপন করছে সে! বসন্ত কি তার জীবন আসবে না? তখনই মনে পড়েছে অনামিকার কথা। দশ বছর বছর হয়ে গেল। তবু ভুলতে পারেনি সে। অগোছালো মন নিয়ে বাস ধরতে চলল। হঠাৎ, বিপ্লবদা বিপ্লবদা বলে কে যেন ডাকছে মনে হল! নিজের নাম শুনে পিছন ফিরে দেখে অনামিকা। মলিন বেশ। সঙ্গে বছর চারেকের ছেলে। অনামিকা বলল, “কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছো না!’’ অবাক হয়ে তাকিয়ে বিপ্লব। কি বলবে বুঝতে পারছে না। অনামিকা বিপ্লবের চোখের ভাষা বুঝে বলল, তার বর মারা গেছে চার বছর আগে। দেওর তাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। দাদার সংসারে থাকে এখন, নানান সমস্যা। ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু বিপ্লব কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। চেতন ফিরে বিপ্লব শুধু বলেছিল, তুই বিকেলে বাড়িতে থাকবি।
না, বিপ্লব সেদিন অফিস যায়নি। মামাকে সমস্তটা বলেছিল। বিকেলে অনামিকাদের বাড়ি গিয়ে দাদার কাছে অনামিকা আর ওর ছেলের দায়িত্ব চেয়ে নিয়েছিল। শুধু অনামিকাকে বলেছিল, “প্রথম থেকে কি শুরু করা যায় না?’’ শুকনো প্রাংশু মুখে ফুটে উঠেছিল ষোড়শীর লাবণ্য।
+ There are no comments
Add yours