You are currently viewing নজরে শান্তিনিবাস

নজরে শান্তিনিবাস

অর্পিতা মজুমদার

রবিবারের সকাল। কাঞ্চননগরের অন্যতম ব্যস্ত বাজার সেন মার্কেটে তাই সকাল সকাল দোকান বসে গিয়েছে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও খুচরো ব্যযসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। কেউ এনেছে গাছের পাকা পেঁপে, লাল শাক, নটে শাক, বতুয়া, কেউ এনেছে সজনে ফুল, কচি সজনে ডাটা, কেউ দেশি হাঁস মুরগীর ডিম, এই রকম কত কিছু। চায়ের দোকানে একপ্রস্ত চা রেডি। শীতের শেষ। বসন্ত আসছে। তায় আবার রবিবার। বাজার ভালোই জমবে আজ। অন্য দিনের তুলনায় সব ব্যবসায়ীরাই ব্যস্ত। সকাল সকাল অনেকেই বাজারের থলে হাতে চলে এসেছে। চা খেয়ে পেপার পড়ে বাজার শুরু করছেন।

প্রতিদিন সকালে হারানের চায়ের দোকানে আসর বসিয়ে থাকেন রায়বাবু, মিত্রবাবু, দাসবাবু, হাজরাবাবু, তলাপাত্রবাবু সহ আরও দশ বারো জন। এরা সবাই কারখানার বিভিন্ন পদে চাকরি করেছেন। এখন অবসর নিয়েছেন। তবে এই পাঁচ জনের জীবনের শেষের দিনগুলো যেন একই ধারায় বইছে। তাই এদের বন্ধুত্ব সব চেয়ে বেশি। আজ সক্কলে চলে এসেছেন। কিন্তু দাসবাবুর দেখা নেই। কেন তিনি আসেননি তা নিয়ে আলোচনা চলল। মিত্রবাবু বলেন, দাঁড়াও একটা ফোন করি। ফোন বেজে গেল, কেউ তুলল না। আড্ডা সেরে বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে দাসবাবুর বাড়ি হয়ে ফেরার প্ল্যান চলছে। এমন সময় কাগজের হকার তপন এসে ঝপ করে সাইকেল থামাল হারানের দোকানের কাছে। এক নিঃশ্বাসে যা বলল তা হল, অমিয় দাসকে কে বা কারা খুন করেছে। কাগজ দিতে গিয়ে সে দেখে সব। কাজের মেয়ে প্রথম দেখে। এখন পুলিশ এসেছে। এইটুকু বলে তপন চলে গেল। এক মুহুর্ত দেরী না করে ওরা চারজন দাসবাবুর বাড়িতে গেলেন।

চার দিন হল অসীম এসেছে কাঞ্চননগরে। তাদের পত্রিকার একটি ব্রাঞ্চ অফিস শুরু হয়েছে এখানে। এডিটোরিয়াল ডিপার্টমেন্টের তদারকিতে কয়েকদিন এখানেই থাকবে সে। অফিসের সেট আপ মোটামুটি রেডি। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে নানান ধরণের খবর করছিল। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে আছে। রবিবার সকালে যোগাভ্যাস সেরে স্নানে ঢুকবে, ঠিক তখনই তপন পেপারটা দিল। সকাল সাড়ে ৮ টা বাজে এখন। বলল, দাদা ও পাড়ায় দাসবাবু খুন হয়েছেন, আপনি যাবেন না কি একবার? অসীম বলে উঠল, কি বলছো! চলো তো দেখি। গায়ে পাঞ্জাবি গলিয়ে তপনের সঙ্গেই বেরিয়ে গেল সে।

কাঞ্চননগর রাঢ় এলাকার একটি শহর। আকারে বিশাল হলেও জন সংখ্যা কম। রাস্ট্রায়ত্ব একটি কারখানার সৌজন্যে শহরের নাম ডাক। এই কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জন বসতি। এই কারখানাকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আরও বেশ কয়েকটি কারখানা। দেশি বিদেশী কোম্পানি। চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে তিন তারা, পাঁচ তারা হোটেল। বাজার, শপিং মল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কর্মযজ্ঞের কারণে মানচিত্রে জ্বল জ্বল করে কাঞ্চননগর। বেশীরভাগ বাড়িতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বাস। ছেলে-মেয়েরা বিদেশে থাকে, নইলে ভিনরাজ্যে‌।

এহেন শহরে কাজের চাহিদা অনুযায়ী বাইরের বহু মানুষের সমাগম ঘটছে দিন দিন। পুরনো যাঁরা শহর শুরুর লগ্নে এসেছিলেন, তাঁদের বেশীর ভাগ এখানেই রয়ে গেছেন। দিন দিন এই সবুজে ঘেরা শহর কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে এই কাঞ্চন নগরেও এসেছে পরিবর্তন। আগে টাউনশিপের পাশাপাশি বাড়িগুলো পরিবারের মত থাকত। পাড়ার সকলে আত্মীয়ের মত থাকত। কিন্তু হায়, এখন সে সব দিন ইতিহাস। দাসবাবুর বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেল সে খবর পেল না কেউ।

শরৎপল্লীর ৩/২১ নম্বর বাড়িটি অমিয় দাসের। ‘শান্তিনিবাস’। তিনতলা বিশাল বাড়িটি সাড়ে পাঁচ কাঠা জায়গার উপর। কারখানা থেকে অবসরের সময় কম দামে এই জমিগুলো কর্মচারীদের দেওয়া হয়। এই অভিজাত পাড়ার সব বাড়িই বিশালাকার। অসীম যখন দাসবাবুর বাড়িতে পৌঁছেছে তখন থানার ওসি সিদ্ধার্থ সরকার তার টিম নিয়ে সমস্ত নথি জোগাড় করছেন। বডি পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারবাবু যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অসীম নিজের পরিচয় দিল। এই ঘটনার কিছু তথ্য সংগ্রহ করছিল অসীমও, নিজের মতন করে। রহস্যের গন্ধ পেলে অসীম আরও মন দিয়ে স্টাডি করতে চায়। কথা প্রসঙ্গে অসীম বলল, ঠিক কি কারণে এমন ঘটনা ঘটল বলে আন্দাজ করেছেন? মিস্টার সরকার বললেন, এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আরও একটু ডিটেলসে অনুসন্ধানের দরকার আছে। দেখি যেমন জানতে পারব আপনাকে আপডেট দেব। আসলে একটু এড়িয়ে যেতে চাইছেন অফিসার। মিডিয়া কি ছাপতে কি ছাপবে, ঠিক আছে? শেষে উপর মহল থেকে চাপ আসুক আর কি!

অসীমও ছাড়বার পাত্র নয়। ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেল পাড়ার মুদির দোকানে। সেখানে মুদির দোকানীর সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ। দোকান থেকে নিজের বাসায় গিয়ে স্নান সেরে নিল। রতনদার রান্না করা ভাত-ডাল-আলু পোস্ত- মাছের ঝোল জমিয়ে খেলো। দুপুরে একটু রেস্ট নেবে, তার উপায় নেই আজ। নিজের এনফিল্ড বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দাসবাবুদের পাড়ায়। সেখানে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে নোটবুকে ফটাফট কি যেন হাবিজাবি নোট নিল। সেখান থেকে বেলা তিনটের সময় আবার অফিসে ঢুকলো। নিজের চেয়ারে বসে বেশ চিন্তিত লাগছিল অসীমকে। সিগারেট ধরালো। ঘন ঘন চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাচ্ছে সে। 

রাতে কপি লিখে অফিসে পাঠিয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু রহস্য ভেদ না হলে শান্তি নেই!

রুটি আর কষা মুরগির মাংস রান্না করে রতনদা রাতের বাংলা সিরিয়াল দেখছিল। অসীমদাকে খেতে দিল। তারপর শুরু করল বিভিন্ন কথা। দাদাবাবু, সেই ছেলেবেলা থেকে আসছি এই এলাকায়। এখানকার বাবুরা বহু টাকা মাইনে পেত, ছেলে-মেয়েদের ভালো স্কুলে পড়িয়েছে, তারা সব বড় বড় চাকরি করে দেশের বাইরে থাকে, বাপ-মায়ের খবর কেউ রাখে না। এছাড়াও আরও অনেক কথা, অসীম খাচ্ছে আর  মাথা নেড়ে বলছে, হুঁ হুঁ।

খাওয়া হলে অসীম সোজা বিছানায় চলে গেল। কিছুতেই আজ ঘুম আসছে না। অনেকগুলো জট দানা বেঁধে আছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় জটগুলো একবার পরিষ্কার হচ্ছে, একবার ঝাপসা। আরো কিছু তথ্য লিখে  রাখল অসীম।

পরের দিন সকালবেলায় হারানের চায়ের দোকানে হাজির হল অসীম। বাকি চারজন সদস্য ছাড়াও আরো অনেক জমায়েত হয়েছে সেখানে। সত্তর পেরোনো মুখগুলো মলিন, চিন্তিত। অসীম নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করল। দাস বাবুর বাড়িতে কে কে আছেন? মিত্রবাবু বললেন, ওনার একমাত্র মেয়ে। বিদেশে থাকে। স্ত্রী গত হয়েছে গেল বছর। একাই থাকতেন। রান্নার মেয়েটা দুবেলা রান্না করে দিত, খাবার ঢাকা দিয়ে চলে যেত, ঠিকে মেয়েটা ঘর ঝাড়পোঁছ করতো। আর একটা মালী ছিল। মাঝে মাঝে বাগানের গাছগুলোর যত্ন-আত্তি করত। এত বড় বাড়িতে একা থাকতেন কি করে? দাসবাবু বললেন, আমরাও তো আছি বাবা। এখন কে কার খবর রাখে? ছেলেদের ইংরাজি স্কুলে পড়িয়েছি। দেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতো, প্রমোশন পেয়ে বাইরে চলে গেল। মাঝে মধ্যে ফোন করে, দায়িত্ব শেষ। এই বেশ ভালো আছি। কোনও বাঁধন নেই। ডাক এলে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারবো।

অসীম এদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছে, বাইরে থেকে নিজেদের খুব খুশি আছে এমনটা দেখালেও, ভিতরে গভীর ক্ষত দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে। দাসবাবুর মৃত্যুটা এদের আরো দুর্বল করেছে।

পরদিন হারানের চায়ের দোকানের আড্ডায় হঠাৎ রায়বাবু বললেন, আচ্ছা দাসবাবুর বাড়িটা কি বিক্রি হয়ে গেছে? উনি তো কিছু বলে যাননি। কাল বিকেলে আমাদের পাড়ার শর্মাজি বললেন, মিস্টার পান্ডে বাড়িটা কিনেছে। কি যে ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। অসীম বলল, তাই বুঝি! তলাপাত্র বলে উঠলেন, না না ওসব কিছু না। সব রটনা। বাইরের লোকেরা ওঁত পেতে বসে আছে। এইসব সম্ভ্রান্ত পাড়ায় বাড়ি কেনার জন্য। দাসবাবুর মেয়ের সঙ্গে কি কথা বলা যায়? বলল অসীম। রায়বাবু বললেন, সহেলী তো কাল রাতেই এসেছে। আমাকে ফোন করেছিল। একাই আছে, খুব ভেঙে পড়েছে। আমাকে ফোন করে বলল, খুব টেনশনে আছে। যাওনা অসীম, তুমি কথা বলে এসো। আমার কথা বলো, তোমার কথা বলতে সুবিধা হবে। ধন্যবাদ কাকু, বলল অসীম। সেখান থেকে সোজা দাসবাবুর বাড়ি।

লোহার গেট খুলে শান্তিনিবাসের সাদা গ্রাভেলসের লন পেরিয়ে এগিয়ে গেল অসীম। থাম দিয়ে ঘেরা খোলা বারান্দা। বারান্দা পেরিয়ে একটা বড় ঘর। ডানদিকে বসার ব্যবস্থা। বাঁদিকে জানলা ঘেঁসে ডাইনিং। তার ঠিক উল্টো দিকে রান্নাঘর। মাঝখানে সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে ইন্ডিয়ান স্টাইলের বাথরুম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে তিনটে বেডরুম। একটা ব্যালকনি। তিনতলায় চিলেকোঠায় একটি গেষ্ট রুম। বহুদিন রং করা না হলেও বাড়িটিতে বেশ আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। সহেলির সঙ্গে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখল অসীম।

সহেলীর বয়স বছর ৪০ হবে। ছিমছাম চেহারা। মুখে একটা শান্ত ভাব। পেশায় গাইনোকোলজিস্ট। স্বামী সম্রাট ফিজিক্সের কঠিন কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। এক ছেলে, ডাক্তারি পড়ছে। সহেলী বলে, বাবাকে বহুবার বলেছি, এসব ছেড়ে চলো আমার কাছে। এখানে কে দেখবে তোমাকে? নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না। ওখানে এত সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বাবা কিছুতেই এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না। মা চলে যাওয়ার পর যেন আরও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন এই বাড়ির সঙ্গে। আসলে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাবাদের বাড়ি ছিল। বাবারা ছয় ভাই, এক বোন। ওদের ঠিক করে খাওয়া-দাওয়াও জুটত না। সে সময় চাকরি পাওয়ার পর বাবা ওদের পড়াশুনা শেখায়, তারা চাকরি পাওয়ার পর কেউ বিশেষ যোগাযোগ রাখেনি। সেই সময় বাবা এই বাড়িটি করেছে, তাই এই বাড়ি বাবার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বলুন তো ভাই, এভাবে কি বাবার যাওয়ার কথা ছিল? কি যে হয়ে গেল! অসীম বলল, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? সহেলী বলল, বুঝতে পারছি না। আমাদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে বহু দিন কোনো যোগাযোগ নেই। সবাই বাবার সঙ্গে বহুদিনই যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। বরং এখানে কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। এক সঙ্গেই থাকত ওরা। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এছাড়া বই পড়া, গান শুনে সময় কাটত বাবার।

নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে অসীম বলল, ঘটনাটা তো এখানে ঘটেছে তাই না?

সহেলী- আজকাল আর ঘরের বিছানাতে শুতে যেত না বাবা। বলত, উপরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই এখানেই শুয়ে পড়ত।

অসীম- এই বাড়ি কি বিক্রি হয়ে গেছে?

সহেলির মুখটা হঠাৎ প্রাংশু হয়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল, একটি অবাঙালি ছেলে বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। আমি না বলে দিয়েছি। আফটার অল এই বাড়িটা বাবার সেন্টিমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আরও কিছু কথা বলার পর অসীম বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। এবার সোজা থানায়।

পুলিশ অফিসার সিদ্ধার্থবাবু বললেন, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করা হয়েছে বুঝলেন অসীমবাবু। মানে, পরিচিত কেউ এসেছিল এবং কোনও রকম সন্দেহ করেননি দাসবাবু। তর্কাতর্কি থেকেই ঘটনাটা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।

এর মধ্যেই বছর ৩৬ এর সিদ্ধার্থের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অসীমের। দুজনে মিলে সামনের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলো।

অসীম- আমি একটা অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি সিদ্ধার্থদা।

সিদ্ধার্থ- সেটা কি রকম!

অসীম- এই অঞ্চলে ভাড়াবাড়ির বেশ রমরমা। বেশিরভাগ বাড়িতে ভাড়া আছে। তবে ইদানিং কালে ভাড়াটা অনেক কমেছে।

ঠিক সেই সময় সিদ্ধার্থের ফোন বেজে উঠল। একটি জরুরী দরকারে সিদ্ধার্থকে রাউন্ডে বেরিয়ে যেতে হল।

ইতিমধ্যে এই এলাকার ক্লাব, বিভিন্ন মুদির দোকানের সঙ্গে কথা বলেছে অসীম। এমনকি বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেয় যেসব দালালরা, তাদের সঙ্গেও কথা বলেছে। দুদিন পরে রাত এগারোটা নাগাদ সিদ্ধার্থের সঙ্গে থানায় বসে পরোটা আর আলুরদম খেতে খেতে আলোচনা চলল অনেক রাত পর্যন্ত। পরদিন দাসবাবুর বাড়িতে এল ওসি সিদ্ধার্থ ও তার টিম। মহিলা পুলিশও ছিল সঙ্গে। তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজছে। সোফার একদিকে সহেলী। পাশের ঘরে পুলিশ অফিসার ও তাঁর সঙ্গীরা, নিজেদের রেখেছেন অন্তরালে।

রান্না সেরে ঝুমা এল। মালী সুনীল তখন বাগানে কাজ করে চলেছে। সহেলী বললেন, ঝুমা, সুনীলকেও ঘরে ডেকে নিয়ে আয়। তোদের সঙ্গে কিছু কথা আছে। সুনীল আর ঝুমা মাটিতে বসলো একটু তফাতে।

সহেলী- ঝুমা, আমি ভাবছি এই বাড়ি নিয়ে কি করব? কেউ তো রইল না।

সঙ্গে সঙ্গে সুনীল বলে উঠল, বিক্রি করে দিন। মোটা টাকা দেবে বলেছে মিস্টার সাউ।

সহেলী- সেটা কে?

ঝুমা- দিদি, ও তো কদিন ধরেই এই বাড়িতে যাতায়াত করছিল। লোকটা খুব ভালো গো! ওই তো কাকুকে ওষুধ, ফল, মিষ্টি কত কি এনে দিত। এবার পুজোয় জামা কাপড় দিল। কিন্তু কাকু কিছুতেই নিলে না গো। আমাদেরকেও দিলে গো। হে হে। দাঁত বের করে হাসল ঝুমা।

সহেলী- তা তোরা নিলি কেন?

সহেলী আবার বলল, তা যা করেছিস বেশ করেছিস। তবে বাড়ি আমি বিক্রি করব না। বাবা-মায়ের স্মৃতি।

সুনীল খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, বিক্রি করে দিন দিদি। কে দেখবে এত বড় বাড়ি। পরে থেকে নষ্ট হবে। 

সহেলী- না সুনীল, কোনও দিনই এই বাড়ি আমি বিক্রি করব না।

সুনীল চোয়াল শক্ত করে বলল, তাহলে আপনার পরিণতিও কাকুর মতই হবে দিদি।

দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে অসীম বলল, তা তুমি ঠিক কত টাকা পেয়েছিলে দাসবাবুকে খুন করার জন্য?

সুনীল অসীমকে দেখেই কোমর থেকে দেশী বন্দুক বের করে চালাতে যাবে, এমন সময় অন্য দিক থেকে সিদ্ধার্থের সার্ভিস রিভলভারের গুলি এসে লাগলো সুনীলের হাতে। সুনীল রক্তাক্ত হাত নিয়ে আর্তনাদ করতে লাগল। সিদ্ধার্থ সুনীল ও ঝুমাকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ স্টেশনে। বন্দুকটিও বাজেয়াপ্ত করা হল।

সেই বিকেলে রায়বাবু, মিত্রবাবু, হাজরাবাবু, তলাপাত্রবাবু সহ সহেলী, সিদ্ধার্থ ও অসীম। চায়ের কাপ হাতে অসীম বলল, আমি দুদিনের জন্য লক্ষ্মীসরাই গিয়ে পুরো ব্যাপারটা জানতে পারলাম।

উত্তরপ্রদেশের এক ধনী ব্যবসায়ীর দাসবাবুর বাড়ির উপর নজর পড়ে। অনুনয়-বিনয় যখন কাজ হচ্ছিল না, টাকার লোভ দেখায়। তাতেও কোনও কাজ না হলে ঝুমা ও সুনীলকে কাজে লাগায়। বিহারের লক্ষ্মীসরাইয়ের একটি ছেলে বছরের বিভিন্ন সময় ফলবিক্রির ছলে আসে কাঞ্চননগরে। ছেলেটি কাঞ্চননগরের এই এলাকার বাড়ির সন্ধান দেয় পাশের জেলার বিত্তশালী লোকেদের। ছলে-বলে-কৌশলে একে একে এই এলাকার বাড়ি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির লোকেরা জানতেই পারছে না। যেহেতু এই শহর বর্ডার এলাকায় এবং শান্ত জায়গা তাই বাইরে থেকে এসে গা ঢাকা দিতেও সুবিধে। তাই দাম দিয়ে কিনে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। বিহারের পুলিশের সাহায্যে ছেলেটি গ্যাং সহ ধরা পড়েছে সিদ্ধার্থদার টিমের হাতে। সবটা স্বীকার করেছে ওরা।

সুনীল ও ঝুমা মাত্র এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে দাসবাবুকে খুন করেছে। বহুদিন ধরেই প্ল্যান করেছিল, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। রবিবার সকালে দাসবাবু আড্ডায় যাননি দেখে ওরা আর দেরি করেনি। ঝুমাই সুযোগ বুঝে সুনীলকে ডাকে। ঝুমার সাহায্যে সুনীলই খুনটা করেছে।

সহেলী যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। নিজের মনেই বলল, গত দশ বছর ধরে ওরা এই বাড়িতে আছে, কি করে করল এটা! রায়বাবু, মিত্রবাবু, দাসবাবু, হাজরাবাবু, তলাপাত্রবাবুরাও যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। সিদ্ধার্থ বলল, চিন্তা করবেন না, পুরো টিমটাই এখন আমাদের হাতে ধরা পড়েছে। আর এই ধরণের ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে হয়।

গাড়িতে ওঠার সময় অসীমকে ধন্যবাদ জানিয়ে থানার দিকে রওনা হল সিদ্ধার্থের জিপ। অসীমের পেট তখন খিদেয় হু হু করে জ্বলছে। রতনদা কি রান্না করেছে কে জানে!

Leave a Reply