মেষপালকের সঙ্গে কিছুক্ষণ
সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ওদের। ভেড়ার পাল নিয়ে ওরা আসে। গ্রামের বাইরে মাঠের ধারে তাঁবু খাটিয়ে দু’তিন দিন থাকে। ভেড়াগুলো সারাদিন চরে ঘাস খায়। ঘাস শেষ হয়ে গেলে আবার ভেড়ার পাল নিয়ে ওরা চলে যায় অন্য কোথাও। ওদের এই এক জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে না থাকা জীবনটাকে আমার দারুণ লাগে। শুধু মনে হয়, ওদের সঙ্গে যদি আমিও কোনও দিন বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পেতাম!

এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি। এখনও যদি কখনও তেমন ভেড়ার পাল নিয়ে মেষপালকদের দেখি, আজও মনটা হু হু করে ওঠে। এমনই একটি দলের সঙ্গে সেদিন দেখা হল। জানতে পারলাম, এই পেশায় নতুন প্রজন্ম নাকি আর আসছে না। তারা চাকরি-বাকরির খোঁজ করছে। বংশের ধারা আর বোধ হয় বজায় থাকবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও আর জানতে পারবে না এই পেশার কথা।
পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দাদু ও বাবার হাত ধরে বিহারের রামবিলাস পালের সেই ছোটবেলায় শুরু হয়েছিল মেষপালকের জীবন। এখন তাঁর বয়স ৭০ বছর। ছাতা, কলসি, কয়েকটা বাটি, তিন-চারটে কম্বল। সঙ্গের সম্পত্তি বলতে এটুকুই। বিহারের বিভিন্ন জেলার অনেকেই মেষ পালনের সঙ্গে যুক্ত বংশ পরম্পরায়। একটি দলে ১৮ থেকে ২০ জন করে থাকেন। তাঁদের কারওর বয়স ৩০ আবার কারওর ৭৫ বছর। তবে যত দিন যাচ্ছে, দলে কম বয়েসিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এক একটি দলে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ভেড়া থাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলার পথে বড় দল ভাগ হয়ে গিয়ে দু’জন করে নিয়ে ছোট দল গড়ে ওঠে। দু’জনের দায়িত্বে থাকে ছয়শো থেকে সাতশো ভেড়া। কোনও একজায়গায় এরা টানা কয়েকদিন থাকেন না। সকাল হলেই হাঁটার শুরু। সবুজ মাঠ ধরে পথ চলা। যত দূর একদিনে যাওয়া যায়। রাত কাটিয়ে পরের দিন আবার যাত্রার শুরু। যেখানে বেশি ঘাস থাকে সেখানে দু’দিনও কেটে যায়।
এভাবে বিভিন্ন এলাকায় দলগুলি ছড়িয়ে যায়। দলে সব চেয়ে যিনি বড়, তাঁর দায়িত্ব ভেড়ার বাচ্চাগুলির দেখভাল করার। রাস্তার ধারে দুপুর বেলায় গাছ তলায় ৪০-৪৫ টি ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে বসেছিলেন রামবিলাস। দিনের আলো নিভে এলে সেখানেই নিজের পালের ভেড়া নিয়ে রাত কেটে যায়। পরের দিন আবার পথ চলা। কিছু দূর গিয়ে আবার অন্য দলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খাবার জন্য সঙ্গে থাকে ছাতু আর ভেড়ার দুধ। এছাড়া কোনও লোকালয়ের আছে এলে কখনও ভাত, আলু-সিদ্ধ ফুটিয়ে খেয়ে নেওয়া। সঙ্গে থাকা ভেড়ার লোমের তিন চারটি কম্বলই ভরসা। সেগুলিরই কোনওটা মাটিতে পেতে, কোনওটা ঢাকা নিয়ে রাতে ঘুম। প্রবল শীতেও রুটিন বদলায় না। রামবিলাস জানান, নির্দিষ্ট সময়ে ভেড়ার লোম মেশিন দিয়ে কেটে নিয়ে যায় মালিকের লোক। তা দিয়ে কম্বল, শীতের পোষাক তৈরি হয়। ভেড়াগুলি সব মালিকের। রামবিলাসরা শুধু প্রতিপালন করেন। সেজন্য মাসে সাত-আট হাজার টাকা পান। সেই টাকা বাড়িতে মানিঅর্ডার করে দেন। বছরে দু’বার বাড়ি যেতে পারেন।

ধানবাদ থেকে বর্ধমান, এই পথেই দিন কাটে তাঁদের। তবে তাঁর ছেলে আর এই পেশায় আসবেন না বলে জানান রামবিলাস। তিনি জানান, তাঁর দুই ছেলে এই পেশায় আসেনি। তারা পড়াশোনা শিখেছে। একজন ব্যবসা করে। অন্যজন দিল্লিতে গাড়ি চালায়। এভাবেই বিহারের প্রায় সব মেষপালকের ছেলেরাই অন্য পেশায় চলে গিয়েছে। রামবিলাস বলেন, আমিই আমার পরিবারের শেষ মেষপালক। বংশ পরম্পরায় আমরা এই ব্যবসায় জড়িয়ে থেকেছি। এই পেশার সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক এবার শেষ হতে চলেছে। আমার বয়স হয়েছে। আর ক’দিন!