‘ঘাঘরবুড়ির মন্দির’ গড়ে ওঠার নেপথ্যে প্রচলিত কাহিনী

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শহরের উপকণ্ঠে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত ঘাঘরবুড়ি মন্দির।এটি আসানসোলের প্রাচীনতম মন্দির। প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার মন্দিরে পুজো উপলক্ষে বহু ভক্ত সমাগম হয়। শিল্পাঞ্চলে পারিবারিক, সামাজিক হোক বা রাজনৈতিক, যে কোনও অনুষ্ঠান বা শুভ কাজে এই মন্দিরে পুজো দেওয়া যেন দস্তুর!

আসানসোল আর রানিগঞ্জ স্টেশনের মাঝে কালীপাহাড়ি ছোট্ট শুনশান স্টেশন।লোকাল ট্রেন ছাড়া কোনও ট্রেন দাঁড়ায় না। তবু মা ঘাগড়বুড়ির কাছে যেতে হলে খুব সহজে যাওয়া যায় এই স্টেশন থেকে। আবার আসানসোল বা রানিগঞ্জ স্টেশন থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যেতে পারে।কালীপাহাড়ি স্টেশনে দু’একটা টোটো পাওয়া যায় এখন। কয়েকবছর আগেও একটু হেঁটে গিয়ে বাস পাওয়া যেত। সেই কালীপাহাড়ি স্টেশন থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরেই মা ঘাগরবুড়ির মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে আসানসোল শহরের সমস্ত বর্জ্য বুকে নিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে নুনিয়া নদী। যদিও এই নদী আগে এমন ছিল না। সময়ের সঙ্গে নিজের রূপ হারিয়ে এখন কেবল নালা।

শিল্পাঞ্চলের অন্যতম জাগ্রত মা ঘাগরবুড়ির মন্দির সেই নুনিয়ার পাশেই। কথিত আছে, জনহীন আসানসোলে ইতি উতি মানুষের বাস ছিল। কাঙালীচরণ চক্রবর্তী গরিব ব্রাহ্মণ। ছড়ানো ছিটানো গ্রাম দু’তিনটি। নুনিয়া নদী পেরিয়ে সেই সব গ্রামে ঘুরে ঘুরে যজমানি করতেন তিনি। নদী পেরিয়েই আবার দিনের শেষে বাড়ি ফিরতেন। দীন ব্রাহ্মণের সংসার চলত কষ্টে শিষ্টে।

এই এরকমই একদিন ব্রাহ্মণ কিছুই পেলেন কোথাও। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত ব্রাহ্মণ সন্ধ্যা বেলা বাড়ি ফেরার পথে নুনিয়া নদীর ধারে গাছ তলায় বসে মা চন্ডীর নাম জপ করতে শুরু করেন। দিনটি ছিল ১ লা মাঘ। হঠাৎ কালীচরণ লক্ষ্য করলেন, এক ঘাগরা পরিহিতা বুড়ি লাঠি নিয়ে ঠুক ঠুক করে অন্ধকারের মধ্যে থেকে আসছেন। গর্জন যেন থেমে গেছে নুনিয়া নদীর। চারদিকে আলো কিন্তু কিছুটা জায়গা অন্ধকার।

সেই অন্ধকার থেকেই আলোর ছটা নিয়ে এগিয়ে আসছে বুড়ি। বুড়ি এসে কালীচরণের কাছে এসে দাঁড়ালেন। চোখ ঝলসে গেল তাঁর। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। স্বপ্নে আবারও বুড়ির দর্শন হল। তিনি কালীচরণকে বললেন, ‘‘তোকে এদিক ওদিকে ঘু্রতে হবে না। এখানে আমার পুজো শুরু কর। তোর কোলে দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি। মাঝখানে আমি– মা ঘাগরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব।’’

ঘুম ভাঙতেই কোলে সত্যিই তিনটি পাথরের মুর্তি পেলেন কালীচরণ। গাছ তলাতেই প্রতিষ্ঠিত হল তিনটি পাথরের ঢিবি। মূর্তি নয় এই পাথরের ঢিবি পুজো হয় এখানে। রূপোর গহনা দিয়ে সাজানো হয় মাকে। ১৬২০ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। গাছ তলায় পুজো শুরু হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পরে দেবীর মাহাত্ম্য। দূর দূরান্ত থেকে মায়ের দর্শনে আসেন বহু পূর্ণার্থী।

আজ ও অম্লান সেই মাহাত্ম্য। বর্তমান বিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার। পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যান্য দেব-দেবীর মন্দির তৈরী করা হয়েছে সামনের প্রাঙ্গনে। আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় মায়ের পুজা হতো নৃত্য-গীত-বাদ্য সহকারে। ১ লা মাঘ আজও মেলা বসে। নানান বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পুজো হয়। দেবী সকলের বাসনা পূরণ করেন । শূণ্য হাতে কেউ ফেরে না মায়ের কাছ থেকে, এমনই বিশ্বাস ভক্তদের। (বিশেষ বিশেষ ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটিও সাবস্ক্রাইব করুন।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *