হ্যালোইনের সন্ধ্যায়
অর্পিতা মজুমদার
ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনা করেছে তিন্নি। এখন বিটেক করছে খড়গপুর থেকে। দীর্ঘ লকডাউনে তিতিবিরক্ত। হ্যালোইন পার্টি করবে বন্ধুরা মিলে। তাও আবার পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসায়!
একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে বন্ধু তমোনাশ। তমোনাশের বাড়ি পানাগড়ের কাছে একটা ছোট্ট গ্রামে। গ্রামের একপাশে চাষের জমি। সেটা পেরোলেই শাল পিয়ালের জঙ্গল। দারুণ সুন্দর জায়গা। গ্রামের নাম সবুজগড়। এই গ্রামের জমিদার ছিলেন তমোনাশের প্রপিতামহ। একসময়ের দো-মহলা বাড়ি গমগম করত অতিথি, জ্ঞাতি-গুষ্টির আওয়াজে। আজ মোট ১৫ জনের সংসার। নীচের মহলে দ্বাররক্ষী, ড্রাইভার, রান্নার লোক আর আব্দুলচাচা সহ ১০ জন থাকে। আব্দুলচাচা সব দেখাশোনা করে। ঠাকুরদার আমল থেকে বংশ পরম্পরায় এই বাড়িতেই আছে। আর উপর মহলে তমনাশের বাবা, দুই বোন, মা আর তমোনাশ থাকে। এখনও অনেক জমিজমা আছে। এছাড়াও তমোনাশের বাবা তন্ময়বাবুর চা পাতার বড় ডিলার। তাই জমিদারি চলে গেলেও আভিজাত্য ও বনেদিয়ানা আজও বজায় আছে।
সেই রায় বাড়ির ছেলে তমোনাশের আমন্ত্রণে এবছরের হ্যালোইন পার্টি হবে সবুজগড়ে রায় বাড়ির বাগান বাড়িতে।
তমোনাশ বহুবার বন্ধুদের তাদের এই বাড়িতে আসতে বলেছে। কিন্তু পড়ার চাপে আসতে পারেনি। দীর্ঘ লকডাউন মনকে ভারাক্রান্ত করেছে। তমোনাশের এই প্রস্তাবে কারও বাড়ি থেকেই না বলেনি। তাই রবিবার সকালেই প্রিয়াঙ্কা, নিশীথ, মঞ্জুরী, মধুরা, চঞ্চল, সৌরভ সকলে গাড়ি করে সবুজগড়ে পৌঁছেছে। এদিন রাতেই তাদের হ্যালোইন পার্টি। সঙ্গে নানান ভুতুড়ে পোশাক, মেকআপ সহ নানান ধরণের খাবার দাবার। পার্টিতে তো আর বাড়ির রান্না চলে না! প্যাকিং করা খাওয়ার, শুধু শেষ বেলায় গরম করলেই হবে। তমোনাশের দুই বোন ওদের সঙ্গে যোগ দিল। পার্টি হবে বাগানবাড়িতে। সেখানে একটু হেঁটে যেতে হবে। ৫ মিনিট লাগে।
সকলে তমোনাশদের বাড়িতেই প্রথমে এল। তমোনাশের মা ওদের জন্য গরম গরম লুচি আর সাদা আলুর চচ্চড়ি রান্না করে রেখেছিল। চঞ্চল আর মধুরা বরাবর আমুদে। এসেই হই হই করে তমোনাশের বাবা-মায়ের মন জয় করে ফেলল, আমাদের তিন্নিও কম যায় না। ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম সেরেই বলল, কাকীমা নাড়ু টাড়ু যা বানিয়েছো তাড়াতাড়ি বের করো। সবাই কলকাতা থেকে এসেছে, সবুজগড়ের এমন সবুজ প্রাণ খোলা বাতাসে যেন সকলেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তারপর লকডাউনের এই গৃহবন্দী দশা থেকে বেরিয়ে যেন মন মুক্ত বিহঙ্গ।
লুচি-তরকারি সঙ্গে ৫ রকমের নাড়ু খেয়ে আশেপাশে ঘুরতে বেরোনোর কথা ঠিক হল সকলে মিলে। মঞ্জুরী বলল, তোদের এখানে পুকুরে মাছ ধরা যায় না? চল না ছিপ নিয়ে যাই। হঠাৎ-ই তমোনাশ সহ ওদের বাড়ির সকলের মুখ প্রাংশু হয়ে গেল। সৌরভ বলল, কি হল? কোনও অসুবিধা আছে নাকি? তমোনাশ বলল, লক্ষ্মী পুজোর পর থেকে ভুত চতুর্দশী পর্যন্ত এখানের কোনও পুকুরে কেউ মাছ ধরে না।
তমোনাশের বাবা রায়বাবু বললেন, তেমন কিছু না, ওই বিশ্বাস আর কি! সবাই মিলে চেপে ধরল রায়বাবুকে। কাকু বলুন না কি ব্যাপার। গল্পের গন্ধ পেয়ে বেড়াতে যাওয়া মাথায় উঠল। তমোনাশদের বাড়ির মেঝে ইতালিয়ান মোজেক দিয়ে তৈরী। দোতলার বৈঠকখানায় মাঝখানে কাশ্মীরি কার্পেট পাতা। তার চার পাশে সেগুন কাঠের নক্সা আঁকা চেয়ার পাতা। নিশীথ কেবল মাটিতে বাবু হয়ে বসল, বাকিরা চেয়ারে জুত করে বসল। রায়বাবু বসেছিলেন নিজের চেয়ারে।
রায়বাবু বললেন, আমার জন্মের আগের কথা, সবুজগড় ছিল ডাকাতদের আখড়া। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা এই অঞ্চলে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে আসে। মাঝে মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এলে ডাকাতের দল আসত। গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার করত। ঠাকুরদা ছিলেন একাধারে তলোয়ারবাজ, অন্যধারে কুস্তিগীর। একদিন ডাকাতের দল আসে আর এই সদ্য তৈরী মহলে হামলা চালায়। বিহারের দারোয়ানরা যখন প্রাণপন লড়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নিজের তলোয়ার নিয়ে বেরোলেন ঠাকুরদা, পাঁচ জন সেখানেই জখম। সর্দার ঠাকুদার ঘাড়ে আঘাত করে পিছন থেকে। ঠাকুরদা ঘুরে চালিয়ে দিলেন তলোয়ার। দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ল পুকুরের জলে। সময়টা ছিল ভুতচতুর্দশী। তারপর থেকে এই সময় গ্রামের সমস্ত পুকুরে নানান অঘটন ঘটে। নতুবা নানান রকম দৃশ্য দেখা যায় নদীর আশেপাশে। দীর্ঘ এত বছর ধরে এই প্রথাই মেনে চলা হয়।
চঞ্চল, সৌরভরা বলল, আজ একটু দেখাই যাক না কি হয়! ওদের চোখে মুখে মজার হাসি। তমোনাশ বলল, একদম না। রাতে কেবল পার্টি হবে। চঞ্চল বলল, হ্যালোইন পার্টি আর ভুতের ঘটনা না থাকলে হয়! মেয়েরা কিছু বলল না, কিন্তু আনন্দ করতে এসে বাধা পেয়ে বিমর্ষ হয়ে গেল।
দুপুরে ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া আর পাঁঠার মাংসের ঝোল দিয়ে সাপটে খেল সবাই। খেতে খেতে রাতের পার্টির নানান পরিকল্পনা হল। কে কি সাজবে, কে কাকে কিভাবে ভয় দেখাবে ইত্যাদি। চঞ্চল ডাকাত-ভূত সাজার প্ল্যান করল। রায়বাবু এই সব মজা করতে বারণ করলেন। শুনবেটা কে, তাতে বেশী উৎসাহ পেল ওরা। যাক খাওয়া শেষ করে বাগানবাড়িতে জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হল। ঠিক হল দীঘির দিকটা দিয়ে ঘুরে ওরা বাগান বাড়ি যাবে।
ওরা দঙ্গল বেঁধে রায় বাড়ির দীঘির ধার ধরে বাগান বাড়ি যাবে। লক্ষ্মী পুজো পেরিয়েছে সবে। বাতাসে হিমেল ভাবটা রয়েছে। বিকেল হলেও সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। দীঘির চারপাশে আম গাছের ঘন জঙ্গল। তাই পড়ন্ত বিকেলে অন্ধকার-অন্ধকার। এই সময় খুব বেশি এই দিকে কেউ আসে না। তাই ফাঁকা। সবাই নিজের মত হাসি ঠাট্টা করতে করতে চলেছে। প্রিয়াঙ্কা আর নিশীথ পিছনে পিছনে চলছে। বাকিরা একটু এগিয়ে গেছে। প্রিয়াঙ্কার চিৎকারে সবাই পিছনের দিকে ফিরল। তখনও প্রিয়াঙ্কা পুকুরের দিকে তাকিয়ে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে দেখল, একটা গলা কাটা মুন্ডু লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে দীঘি জুড়ে। আর একটা মুন্ড কাটা দেহ পুকুরের অন্য পাশে ছোটাছুটি করছে। সে এক ভয়ংঙ্কর দৃশ্য! সকলেরই জ্ঞান হারানোর দশা।
সব ফেলে সবাই দৌড় দিল তমোনাশের পিছন পিছন। তমোনাশদের বাড়ির সামনে এসে তিন্নি আর মধুরা জ্ঞান হারাল। পরের দিন সকালে যখন ওদের জ্ঞান ফিরল তখন ওরা তমোনাশদের ঘরে বিছানায়। পাশে তিনজন ডাক্তার। আর বাড়ির বাকিরা প্রত্যেকেই সুস্থ।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তমোনাশের বাবা রায়বাবু ও আব্দুলচাচা সকলকে বাড়ি পৌঁছে দিল। হ্যালোইন পার্টি হল না ঠিকই। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা হল, যা ওদের চিরদিন মনে থাকবে!