বাজার অর্থনীতি। গ্লোবালাইজেশন। এই শব্দগুলো শুনলেই মনে হয়, বেশ অনেকটা এগিয়ে গেছি। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার মোটামুটি ভাবে চার দশক পরে এই অর্থনীতির ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। তারপর তো কত কি হয়ে গেল!
বাজার অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল, অর্থনীতিকে চাঙা করে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থনীতির পাশাপাশি মূলত এই পরিবর্তন হওয়ার ছিল, শিক্ষায়, দীক্ষায়, আচার-ব্যবহারে, সামাজিক আচার-আচরণে। কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের ফল এদেশের সমাজে এখন পর্যন্ত যেভাবে দেখা গিয়েছে, তা কিন্তু মোটেও সুখকর নয়। নতুন ধরণের অর্থনীতি চালু হওয়ায় এটা হয়তো কিছুটা সত্যি যে সমাজের সব ধরনের মানুষের হাতে কিছু কিছু টাকা এসেছে। আমাদের দেশে শিক্ষা এখনও সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। ২০২০ সালেও গ্রাম বা মফস্বলের সরকারি স্কুলে গেলে দেখা যায়, বহু পড়ুয়াই পরিবারে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। ফলে টাকা এলেও তা জীবনের মানোন্নয়নের সঠিক কাজে লাগানোর মতো বুদ্ধি বা জ্ঞান অনেকেরই নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বাজার অর্থনীতির হাত ধরে সবার হাতে এখন দামি স্মার্টফোন। আগে টেলিফোন ছিল শুধু বার্তা দেওয়া-নেওয়ার জন্যই। সাধারণ মোবাইল ফোন যখন এদেশে চালু হল তখন প্রথম পর্যায়ে তা একান্তভাবেই ছিল উচ্চবিত্তের নাগালে। বলা বাহুল্য, আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির কারণে উচ্চবিত্তের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি থাকে। তাই মোবাইল ব্যবহারের স্বঘোষিত সীমাবদ্ধতা বজায় ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু বাজার অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে মোবাইল সর্বস্তরে ছড়িয়ে গেল। যতদিন যেতে লাগল, স্মার্টফোনের দাম কমে গেল, পাল্লা দিয়ে কমতে থাকল কথা বলার খরচ। চালু হয়ে গেল প্রায় বিনা পয়সার ইন্টারনেট। কিন্তু সেই ইন্টারনেট ক’জন আর নিজের কাজে লাগাচ্ছেন? যা হতে পারত উন্নয়নের অন্যতম প্রধান সোপান, তা কি সত্যিই বাস্তবায়িত হচ্ছে এদেশে?
আসলে জীবন যাপনে সুবিধে হয়েছে ঠিকই কিন্তু কুফল বোধ হয় আরও বেশি। হয়তো ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে যে কাজ করার কথা ছিল তা হয়ে যাচ্ছে ঘরে বসে। খাবার কিনতে রেস্তোঁরায় যাওয়ার সময় বেঁচেছে। ঘরে বসেই কত অ্যাপ, অর্ডার দিলেই মনপসন্দ খাবার পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, কিভাবে চলাফেরা কমে গিয়েছে আমার-আপনার! শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ার ফল পড়তে শুরু করেছে দেহে, মনে। সঙ্গে অনুসারি উপসর্গ হিসাবে শরীরে বাসা বাধতে শুরু করেছে রোগ-বালাই। শিশুরা আর গল্প শুনতে চায় না। তাদের সে ধৈর্য্য নেই। কারণ? হয় সে টিভিতে কার্টুন দেখে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিজ্ঞাপনের বিরতি। তার মনও সেই অনুযায়ী কনসেনট্রেশন বজায় রাখছে। ততক্ষণ, যতক্ষণ কার্টুন টিভির পর্দায় চলছে। বিজ্ঞাপনের বিরতি মানেই তারও বিরতি। এর প্রভাব পড়ছে যে কোনও কাজে। ফলে সামান্য বেশি সময়ের জন্য যে কাজ তাতে আর তার কনসেনট্রেশন থাকছে না। গল্প শোনার ধৈর্য্য আসবে কোথা থেকে? আবার গল্প না শুনলে মন কল্পনাপ্রবণ হয় না। কল্পনাপ্রবণ না হলে মন সৃষ্টিশীল হয় না। সাধারণ সুক্ষ্ম অনুভূতি জাগ্রত হয় না। ফলে শিশু বড় হচ্ছে। পরীক্ষায় ভালো ফলও করছে। কিন্তু অন্যের বিষয়ে তার কোনও আগ্রহ থাকছে না। সামাজিক দায়িত্ব পালন তো দূরের কথা, পরিবারের ভালো-মন্দে মাথা ঘামাচ্ছে না। এভাবে ক্রমশ সে একা হয়ে যাচ্ছে। অবসাদ হয়ে উঠছে নিত্যসঙ্গী। বাড়ছে স্ট্রেশ জনিত নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। সব মিলিয়ে সে নিজে ভালো থাকছে না। আর নিজে কেউ ভালো না থাকলে আশপাশের মানুষকেও সে ভালো রাখতে পারে না। ফলে সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সমাজের উপর।
শিক্ষা আত্মিক ভাবনা-চিন্তার উন্নতি ঘটায়। শিক্ষার প্রসারে সরকারি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সর্বশিক্ষা মিশনের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েকে স্কুলমুখী করা গেছে। কিন্তু আদৌ কতটা সমস্যা সমাধান হয়েছে তা বিবেচনার বিষয়। আমাদের ভাবতে হবে। মা পরিচারিকার কাজ করেন, বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। অথচ ছেলেমেয়েরা ব্রেকফাস্টে খাচ্ছে নুডলস, সাধারণ নয়, অবশ্যই ব্রান্ডেড যার বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত টিভিতে চলছে। কারণ কি? সেই বাজার অর্থনীতি। বাবা-মা দিনরাত পরিশ্রম করে যে অর্থ উপার্জন করছেন, সঞ্চয় তো দূরের কথা। সারাক্ষণ তাঁদের সামনে ঝকঝকে এলিইডি টিভির হাতছানি। পরিচিতের বাড়িতে দেখছেন, টিভিতে, রাস্তাঘাটে বিজ্ঞাপন দেখছেন। রোজগারের অর্থ ঢেলে দিয়ে কিনে ফেলছেন বিশাল এলইডি টিভি। পুরোটা হচ্ছে না। তাই কিছুটা ধারও থাকছে। যাকে বলে ইএমআই। পরের কয়েক মাস আগে সেই ধার মেটাচ্ছেন তাঁরা। তারপরে অন্যকিছু। অথচ সেই টাকা দিয়ে হয়তো ঘরের দেওয়ালের ফাটলটা মেরামতি করা হয়ে যেত। এভাবে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ পরিবার। অকারণে পরিবারে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। ১০ বাই ১০ ফুট কামরার ঘরে বসে টিভি দেখে বাচ্চার চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। না হয় অন্য সময় হাতে স্মার্টফোন নিয়ে কারিকুরি করে চলেছে। বহু বাড়িতেই বড়রা আবার এসবে উৎসাহও দিয়ে থাকেন।
খাদ্যাভ্যাসে কিভাবে বিশ্বায়ন প্রভাব ফেলেছে দেখুন। অপুষ্টি দূর করতে স্কুলে চালু হয়েছে মিড ডে মিল। কিন্তু মফস্বলের বহু স্কুলে মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্ন বিত্ত পরিবার থেকে আসা বহু শিশুরও নাকি এই খাবারে রুচি নেই। কারণ, টিভিতে কত কি খাবারের বিজ্ঞাপন সারাদিনে। ফাস্টফুড খেয়ে কত শিশু অকালে পেটের রোগে কাবু হয়ে যাচ্ছে। অথচ বহু বাবা-মা বাচ্চা চিঁড়ে,মুড়ি,রুটি খায় না বলে বেশ গর্ব অনুভব করেন। স্কুলে মিড ডে মিল না খেয়ে বাড়িতে এসে ফাস্ট ফুড, নুডলস জাতীয় খাবার খাওয়ার দরুণ বাচ্চার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে নামিদামি সব অভিনেতা-অভিনেত্রী বা সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের দ্বারা। যাদের দেখে ছোটরা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এবং বায়না করছে বাবা-মা’দের কাছে। যেহেতু এখন সব একটি, দুটি করে সন্তান, বাবা-মা বাৎসল্য স্নেহ থেকে বায়নার থেকেও হয়তো বাচ্চাকে বেশি পরিমাণে এনে দিচ্ছেন। কেউ নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যে আনছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে বাড়ির তৈরি খাবারে উৎসাহ নেই বাচ্চাদের। বাইরের খাবার খেয়ে ওবেসিটির হার বাড়ছে। আগে বাচ্চারা দুধ কিংবা রুটি তরকারি মুড়ি খেতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু বাজার অর্থনীতির হাত ধরে বদলে গিয়েছে সেই অভ্যাস। আর এই বদলের হাত ধরেই আসছে বিভিন্ন ধরনের অসুখ। ছোট থেকে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিশোর বয়সে পৌঁছানোর আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। অ্যংজাইটি, অবসাদ, একাকিত্ব, মানসিক নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে সমাজ।
বিশ্বায়নের ফলে কিভাবে বদলে যেতে পারত দেশের পুরো চিত্রটা। কিন্তু শিক্ষার অভাবে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ নিয়ে আসছে এই বিশ্বায়ন। তাই, সমাজ বা দেশের জন্য না হোক, অন্তত নিজের বাচ্চার ভালো থাকার জন্যও আমাদের ভাবা জরুরি। আর কে না জানে, একজন মানুষ ভালো থাকলে তিনি আশপাশের মানুষকেও ভালো রাখতে পারেন। তাই সবাই যদি আমরা নিজের নিজের বাড়িতে উদ্যোগটা নিতে শুরু করি, বদল কিন্তু আসবেই।
+ There are no comments
Add yours