খাজা আনোয়ার বেড়. Mausoleum of Khwaja Anwar /Nawab Bari
খাজা আনোয়ার বেড়. বর্ধমান শহরে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। সারাদিন ঘুরেও দেখে শেষ করা যাবে না। বরং একরাত থেকে পর পর দু’দিন ধরে দেখলে ভালো হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল খাজা আনোয়ার বেড় বা নবাব বাড়ি (Mausoleum of Khwaja Anwar /Nawab Bari) বর্ধমান শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। প্রায় তিনশো বছরের পুরানো ঐতিহাসিক স্থাপত্য। ইতিহাস অনুরাগীরা অনেকেই বছরের বিভিন্ন সময়ে এই স্থাপত্য পরিদর্শনে আসেন। প্রতি বছর পয়লা মাঘ মেলা বসে। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়।
জানা যায়, দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে আওরঙ্গজেব পুত্র মুয়াজ্জেম
প্রথম শাহ আলম বাহাদুর শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। মাত্র ছ’বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর
সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয় রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃবিরোধ। জ্যেষ্ঠ পুত্র আজিম-উস-শান সিংহাসনে বসেন। এক বছরের
মধ্যে তিনিও ভাই জাহাঙ্গির শাহের চক্রান্তে নিহত হন। আজিম-উস-শানের পুত্র ফারুখ শিয়ার জাহাঙ্গির শাহকে
হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন।
দিল্লির এই ভ্রাতৃঘাতী গৃহবিবাদে দেশ জুড়ে গোলযোগ তাঁর আঁচ এসে লাগে বাংলার বর্ধমানেও। এখানে পাঠান
সর্দারদের প্রধান রহিম খান মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ফারুখ শিয়ার বিদ্রোহ দমনে দুই বিশ্বস্ত
সেনাপতি খাজা সৈয়দ আনোয়ার (Nawab khawaja Anwar) ও খাজা আবুল কাসেমকে পাঠান। শহরের দক্ষিণ দামোদর এলাকায় শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। রহিম খান সন্ধি প্রস্তাব পাঠালে যুদ্ধ থামে। কিন্তু রহিম এই সুযোগে হত্যা করেন দুই মোঘল সেনাপতিকেই।
আরও পড়ুন- দেশে মাত্র দুটি ১০৮ শিবমন্দির রয়েছে, দুটিই রয়েছে এই বাংলায়
বিশ্বাসঘাতকতার শিকার দুই সেনাপতিকে শহিদ আখ্যা দেওয়া হয়। ফারুখ শিয়ারের নির্দেশে বর্ধমান শহরের বেড়
এলাকায় প্রায় ১০ বিঘা জমির উপরে লক্ষাধিক স্বর্ণমুদ্রা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। দুই সেনাপতির বংশধরদের
‘নবাব’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের জন্য তৈরি হয় রাজকীয় প্রাসাদ, মকবরা, বাঁধানো সরোবর, ফুলবাগান। মুঘল
স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইন্দো-সিরীয় আঙ্গিক ও মিনার শৈলীর সঙ্গে বাংলার দোচালা মন্দিরের স্থাপত্য মিশিয়ে গড়ে
উঠেছে সৌধ। গড়ে তোলা হয় একটি মসজিদও। মসজিদের তিনটি গম্বুজ, চারটি মিনার। কারুকাজ অপূর্ব সুন্দর।
খাজা আনোয়ার বেড়. সমাধিক্ষেত্রটি যথাযথ সংরক্ষণের জন্য দিল্লীর সম্রাট পাঁচটি মৌজা দান করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার আগে ওই পাঁচটি মৌজা বর্ধমান মহারাজার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্ধমানের মহারাজা প্রতি বছর ৩,৬৯০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতেন। ব্রিটিশ সরকারের তরফে সমাধিক্ষেত্রের ব্যয়ভারের জন্য মাসিক ৩২১ টাকা ৫ আনা ৪ পাই বংশধরদের নির্ধারিত প্রতিনিধিকে দেওয়া হত। এঁদের শেষ প্রতিনিধি মির্জা শি গুপ্তা ১৯৪৮-এর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রদত্ত অর্থ গ্রহণ করেন। মির্জা শি গুপ্তার মৃত্যুর পর তাঁকেও এই নবাববাড়ি প্রাঙ্গণেই সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর বংশধরেরা বর্ধমান ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীকালে কবরস্থান, পুকুর, মসজিদ সহ সমগ্র সম্পত্তি বংশধরদের ব্যক্তিগত ওয়াকফ সম্পত্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু এই বিশাল সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের আর্থিক ক্ষমতা পরিবারের নেই। তাই দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে খাজা আনোয়ার বেড়। একমাত্র সরকার যদি এগিয়ে আসে তবেই হয়তো এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
কীভাবে যাবেন?
বর্ধমান স্টেশন থেকে গাড়ি করে যেতে পারেন। খুব বেশি দূরে নয়। একবার সেখানে গিয়ে পড়লে মন চলে যাবে সুদূর অতীতে। স্থাপত্যের প্রতিটি কোণা দেখতে দেখতে আপনি উপভোগ করতে পারবেন প্রায় তিনশো বছর আগের সেই সময়কে। পরতে পরতে খুঁজে পাবেন তখনকার ইতিহাসকে। তাই আর দেরি না করে একদিন বেরিয়ে পড়ুন। (কৃতজ্ঞতা- পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন) (বিশেষ বিশেষ ভিডিও দেখতে DURGAPUR DARPAN ইউটিউব চ্যানেলটিও সাবস্ক্রাইব করুন)।
+ There are no comments
Add yours