আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত জনগোষ্ঠী। আমরা তার খোঁজও রাখি না। আমরা সব সময় ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে ভাবতে। অথচ কালে কালে দেশ-বিদেশ থেকে কত জনগোষ্ঠী ভারতে এসে বংশানুক্রমিকভাবে থাকতে থাকতে পুরোদস্তুর ভারতীয় হয়ে গিয়েছে তা আমরা জানতেও পারি না। কয়েকশো বছর আগে পর্তুগাল থেকে এদেশে এসে কিভাবে একদল মানুষ কালক্রমে বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, কিভাবে তাঁরা একদিন আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে উঠলেন, সেই তথ্যই থাকছে এই লেখায়।
ইউরোপে সিআর সেভেনের পায়ে বল পড়লেই রক্ত ফুটতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের মহিষাদলের গেঁওখালির মীরপুরের টেসরা, রোজারিও, ডি ক্রুস, পেদেরাদের। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যও বলা যায় আবার বিভেদের মাঝে মিলন মহান, বলা যায় এ’কথাও। পর্তুগীজ রক্ত শরীরে নিয়েও ওই গ্রামের বাসিন্দারা কবে কবে হয়ে গিয়েছেন আপাদমস্তক ভারতীয়। সবাই কথা বলেন বাংলায়। ভুলে গিয়েছেন পূর্বপুরুষের ভাষা পর্তুগীজ।
ঠিক কবে পর্তুগাল থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এদেশে এসেছিলেন তা তাঁরা বলতে পারেন না। তবে এটা জানেন, শুরুতে পর্তুগাল থেকে তাঁরা এসেছিলেন গোয়ায়। ইতিহাস খুঁজলে জানা যায়, প্রায় তিনশো বছর আগে মহিষাদলের রাজপরিবার বর্গি হানার হাত থেকে বাঁচতে গোয়া থেকে ১২ জন পর্তুগীজ সৈন্যকে নিয়ে আসেন। মীরপুরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জলপথে বর্গীরা মহিষাদল আক্রমণ করলে তাঁরা রুখে দাঁড়ান। তাঁদের অসমসাহসী লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে বর্গীরা। খুশি হয়ে তাঁদের মীরপুরে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে নিষ্কর জমি দেওয়া হয়। পাকাপাকি ভাবে তাঁরা এখানে থাকতে শুরু করেন। নিজের দেশে ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা, তাঁরা গোয়াতেও আর যাননি।
প্রভূ যীশুর উপাসনার জন্য দুটি চার্চ গড়ে ওঠে গ্রামে। মীরপুরে থাকতে থাকতে তাঁরা স্থানীয় বাঙালী মেয়েদের বিয়ে করে সংসারী হন। বিয়ের পরে মেয়েরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীস্টান হয়ে যান। নামও বদলে যায় তাঁদের। বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। পর্তুগীজ কলোনি বা ফিরিঙ্গি পাড়া বলে পরিচিত হয় মীরপুর। বংশ পরম্পরায় পর্তুগীজ রক্ত বহন করে আসছেন মীরপুরবাসী। যদিও কালে কালে পুরোপরি বাঙালি হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ভাষা বদলেছে। বাংলায় কথা বলেন তাঁরা। অতীতে তাঁদের চোখের মণি ছিল নীল রংয়ের। ধীরে ধীরে তা কালচে হতে শুরু করে। এখন তাঁদের অনেকে আক্ষেপ করেন, ভাষা তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে। চোখের রংয়ে প্রমাণ ছিল পূর্বপুরুষের। এখন আর সেটুকুও নেই!
এক সময় শুধু মাছ রান্নার গন্ধ শুঁকে বোঝা যেত, আশপাশের আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে এখানকার অধিবাসীদের পার্থক্যটা। বিভিন্ন মশলা দিয়ে রান্না করা হতো মাছ। অথচ এখন বাঙালিদের মতোই ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে দিন কাটে তাঁদের। মহিলারা পরতেন স্কার্ট ও রাপার। সন্ধ্যায় সবাই চার্চে যেতেন প্রার্থনা করতে। কালে কালে সব বদলে গিয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে তাঁদের। মেয়েরা এখন শাড়ি পরেন। বড়দিনে চার্চ সাজানো হয়। মেলা বসে। খোল-করতাল নিয়ে বাংলা গানের আসর বসে। বাঙালিদের কীর্তনের মতো করে। শুধু হরিনামের বদলে যীশুখ্রীষ্টের গান করেন তাঁরা।
নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে তাঁদের আর কোনও যোগ নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পর্তুগালের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযাগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিশেষ সাড়া মেলেনি। তবে পর্তুগালের ফুটবল নিয়ে আবেগ টিকে রয়েছে এখনও। পর্তুগাল ভালো খেললে উৎসবের মেজাজ ছড়িয়ে পড়ে দেড়শো পরিবারের এই গ্রামে।
+ There are no comments
Add yours