কে ছিল ওখানে!

 

বাঁকুড়া থেকে দামোদরের ব্যারাজ পেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগোলে ডিপিএল কলোনি। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল শহর গড়ে ওঠার সময় বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে তৈরী হয়েছিল দুর্গাপুর প্রোজেক্টস লিমিটেড বা ডিপিএল। প্রজেক্টের আধিকারিক ও কর্মীদের থাকার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল ডিপিএল কলোনি। কোয়ার্টার, রাস্তাঘাট, বাজার, স্কুল, হাসপাতাল- সব। তারপর কেটে গেছে কতগুলো বছর। কত কথা বলে এই কলোনির পথঘাট। বহু বছরের সেই গাছগুলো যেন সব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

বৈশাখের এক রবিবার আমরা ক’জন বন্ধু বিষ্ণুপুর থেকে একটি গাড়ি করে ফিরছি। বড়জোড়ার কাছাকাছি আসতেই দেখি, আকাশে মেঘ ঘনাচ্ছে। ব্যারাজের উপর আসতে না আসতে ঘন কালো হয়ে গেল আকাশ। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তাই বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে কলোনির মধ্যে দিয়ে শর্টকাট ধরেছি। ততক্ষণে হাওয়া শুরু হয়েছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা গাড়ি দাঁড় করানো হল। কিছুক্ষণের মধ্যে চারিদিক বিদীর্ণ করে ঝেপে বৃষ্টি এল। প্রায় আধঘন্টা গাড়িতে বসে আছি। ঝড়ের দাপট তখনও বহাল তবিয়তে চলছে। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম একটা চায়ের দোকান রয়েছে কাছেই।

গাড়িটা একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দোকানের সামনে দাঁড় করানো হল। সবাই মিলে গাড়ি থেকে নেমে চায়ের ঘুমটির একটু ভিতর দিকে ঢুকে বসলাম। লোডসেডিং চলছে। চারিদিকে চাপা অন্ধকার। সঙ্গে নাগাড়ে বৃষ্টি। দোকানে খোলা পরিবেশে হাল্কা লাগছিল। দোকানি চা বানানোর পাশাপাশি চপ বানানোর তোড়জোড় করছেন। আমাদের মধ্যে দীপক হঠাৎ বলল, কাকা এত বৃষ্টির মধ্যে বিক্রি হবে চপ? মুচকি হেসে দোকানি শুধু মাথা নাড়ল। অনিলের শুধু ছবি তোলা স্বভাব। বেসন মাখা দোকানির ছবি তুলল ও। নিজের সেল্ফি তুলল টিমটিমে হ্যারিকেনটির পাশে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যেই গরম ধুমায়িত চা আর তেল সপ সপে চপ শালপাতার একটা প্লেটে করে আমাদের পাশে দিল দোকানি। আমরা বাঁশের মাচার ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছি। বৃষ্টির রাতে এমন চা আর গরম গরম চপ, জমে গেল একেবারে!

ততক্ষণে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। আর দেরী না করে দাম মিটিয়ে চটপট গাড়ি স্টার্ট দিলাম। মাইল দুই পেরিয়েছি। খেয়াল হল, মোবাইলটা ফেলে এসেছি চায়ের দোকানে। অগত্যা গাড়ি ঘোরাতে হল। বৃষ্টি থেমেছে। বিদ্যুতের ঝিলিক আকাশের বুকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে। কারেন্ট তখনও আসেনি। বহু গাছপালা ভেঙে পড়ে রয়েছে। বিদ্যুতের তারও ছিঁড়েছে নিশ্চিত। সারাতে সময় লাগবে।

সেই জায়গায় এসে গাড়িটা এদিক করছে। আমি তপনকে বললাম কি রে কি হল! এত দেরি হচ্ছে কেন? এই সামনেই তো ছিল দোকানটা। তপন বলল কোথায় কি? আমরা সত্যি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না ।  তবে কি ভুল পথে এলাম। এরই মধ্যে আমার ফোনের রিং টা শুনতে পেলাম আমি। ঠিক পেছন থেকে আসছে আওয়াজটা। সেদিকে ঘুরে দেখি, গাছ তলায় পড়ে আছে আমার ফোনটা। দৌড়ে গিয়ে সেটা তুলতেই দেখি, মায়ের ফোন। তুতুল কখন থেকে চেষ্টা করছি, পাচ্ছিলাম না তোকে। রাত ১ টা বাজছে। কোথায় তোরা? সন্ধ্যার সময় বললি চলে এসেছিস কাছাকাছি! কি যে তোদের ব্যাপার, বুঝি না বাপু!”

বুঝতে কি আর আমরাই কিছু পারছি তখন? কোথাও দোকান নেই। ঘড়িতে সত্যি সত্যিই রাত ১ টা বাজছে। আর দাঁড়াইনি এক সেকেন্ডও। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে তপন। আমাদের কারও মুখে কথা নেই। এতক্ষণ  কোথায় ছিলাম আমরা? কে আমাদের চা, অমন চপ খাওয়ালো?

গাড়ি চলেছে একনাগাড়ে। মধ্যরাত্রের রাস্তা, একবারে শুনশান।

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours