হিন্দু মন্দিরে যান মুসলিমরাও, পাকিস্তান-আফগানিস্তানে রয়েছে এমন একাধিক মন্দির

পাকিস্তানের বালুচিস্তানের হিংগুল নদীর তীরে দুর্গম এক গুহা। হিন্দুদের ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। হিন্দুদের কাছে তা পরিচিত মরুতীর্থ হিংলাজ নামে। সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিংলাজ। পাকিস্তানের বালুচ মুসলিমদের কাছে তিনি পরিচিত ‘নানী কি হজ’ নামে। হিন্দু দেবীকে পুজো করেন বালুচ মুসলিমরাও। পাকিস্তানে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এই হিন্দু দেবীকে স্থানচ্যুত হতে হয়নি মূলত বালুচ মুসলিমদের বাধায়। তাঁদের মতে, দেবী খুবই জাগ্রত। তাঁদের সুরক্ষা দিয়ে থাকেন। এমনকি মন্ত্রী-আমলারাও সেখানে গিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে আসেন।

অতীতে তীর্থযাত্রীরা হিংলাজ যেতেন উটের পিঠে চড়ে৷ যাত্রা শুরু হত করাচির কাছে হাব নদীর তীর থেকে। যাত্রীদের সঙ্গে থাকত রসদ। তাঁবু, জ্বালানি থেকে শুরু করে পানীয় জল, চাল, ডাল, আটা, তেল, মশলা সহ সব সামগ্রী। সেই সময় মরুভূমির দস্যুদের উপদ্রব ছিল। তাই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে থাকত অস্ত্রশস্ত্র। এক মাসের দুর্গম যাত্রাপথ পেরিয়ে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন হিংলাজে৷ এরপর অঘোর নদীতে স্নান সেরে তাঁরা দর্শন করতে যেতেন দেবী হিংলাজকে। এখন অবশ্য করাচি থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা গাড়িতে করেই পৌঁছানো যায় সেখানে। ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তীর্থযাত্রীরা সেখানে যান।

Hinglaj Nani Mandir Pix- Wikipedia Commons

কোনও দেবী মূর্তি নয়, সিঁদুর লেপা এক খণ্ড পাথরই হলো হিন্দুদের হিংলাজ মাতা আর বালুচ আদিবাসীদের আদরের নানী। গুহামন্দিরের ভেতরে আছে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড। মন্দিরের কাছে আছে আরও একটি কুণ্ড। কুণ্ডের মধ্যে অবিরাম কাদা মাটি ফুটতে থাকে। হিন্দুরা ফুল ও নারকেল এবং মুসলিমরা সির্নি ও খেজুর দেন দেবীকে। নানী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে হজ যাত্রার তদারকি, পুরোটাই করেন বালুচ মুসলিমরা। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, হিংলাজ মাঈ বা বিবি নানী তাঁদের পরিবারেরই একজন। তিনিই তাঁদের সুরক্ষা দিয়ে থাকেন, সংসারে মঙ্গল নিয়ে আসেন।

বালুচিস্তানেই আরও এক হিন্দু মন্দির রয়েছে, কালাটেশ্বরী কালীর মন্দির। কয়েক হাজার বছর ধরে নাকি সেখানে দেবী পূজিত হয়ে আসছেন। আজও দেবীর পুজো হয় মহাসমারোহে। সহযোগিতা করেন বালুচ মুসলিমরা। প্রায় কুড়িফুট উঁচু বিগ্রহ। দশ হাত। গদা, তরবারি, ঢাল, খড়্গ, ত্রিশুল, চক্র, ধনুক সহ রণ সাজে সজ্জিতা দেবী। গলায় করোটির মালা। হাজার হাজার ভক্ত এই মন্দিরে আসেন। সকাল-সন্ধ্যায় নিত্যপুজো হয়। এই কালী মন্দিরে কালীপুজো ছাড়াও দশেরা, হোলি, গুরুপূর্ণিমা জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয়ে থাকে।

আফগানিস্তানের কাবুল শহরের মাঝে কোহই-আশামাঈ পর্বত। পর্বতের চূড়ায় রয়েছে হিন্দু দেবী আশামাঈয়ের মন্দির। বলা হয়ে থাকে, মন্দিরে গত চার হাজার বছর ধরে ধিকিধিকি জ্বলছে এক পবিত্র বহ্নিশিখা। শুধু হিন্দুরা নয়, স্থানীয় মুসলিমরাও বিশ্বাস করেন, ‘আশামাঈ’ কাবুলকে বিপন্মুক্ত করে রাখেন। তালিবানরা ডিনামাইট ও কামান দিয়ে বামিয়ানের বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু আশামাঈ মন্দিরের কোনও ক্ষতি তারা করেনি। শোনা যায়, আমেরিকা ও জোটের বিমানহানায় আশামাঈয়ের পুরোনো মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় মুসলিমদের সাহায্যে বিমানহানার আগেই মন্দির থেকে প্রদীপ বের করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তালিবানের রক্তচক্ষুতে তখন হিন্দুরা কার্যত গৃহবন্দী। কিন্তু মুসলিমরাই প্রদীপে ঘিয়ের জোগান দিয়েছিলেন। তালিবান শাসন শেষ হওয়ার পরে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিমরাও এগিয়ে আসেন নতুন মন্দির গড়ার কাজে। ২০০৬ সালে নতুন মন্দিরের উদ্বোধন হয়। হোলি ও দিওয়ালি তো বটেই, নবরাত্রির দিনগুলিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ আসেন, দেবী ‘আশামাঈয়ের কাছে মানত করেন।

কমিউনিষ্ট চীনে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে। অথচ সেখানকার গুয়াংঝাউ শহর থেকে কিছুটা দূরে চেরিয়ান গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দারা সবাই বৌদ্ধ। কিন্তু এই গ্রামেই শত শত বছর ধরে অধিষ্ঠাত্রী এক দেবীর। পাথরের ছোট্ট মন্দিরে পদ্মাসনে বসে আছেন চার হাতের দেবী মূর্তি। পায়ের তলায় এক দৈত্য। দু’দিকে দুই রক্ষী। গ্রামবাসীরা এই দেবীকে ভগবান বুদ্ধের মহিলা রূপ গুয়ানাইনের মূর্তি হিসেবে পুজো করেন। অনেকেরই বিশ্বাস, গুয়ানাইন দেবী কোনও এক হিন্দুদেবীর পরিবর্তিত রূপ। কারণ বিগ্রহের রূপ, পুজোর পদ্ধতি, পুজোর মন্ত্র চীনের অন্য জায়গার পুজোর থেকে কিছুটা আলাদা। অতীতে গুয়াংঝাউ ছিল চিনের বন্দরনগরী। ব্যবসাসূত্রে এসে এখানেই বসবাস শুরু করেছিলেন তামিল ব্যবসায়ীদের অনেকে। তাঁরাই ভারত থেকে পাথর নিয়ে গিয়ে তাঁদের আরাধনার জন্য স্থানীয় ভাস্করকে দিয়ে বিগ্রহ বানিয়ে নিয়েছিলেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!