কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা নিয়ে আসল সত্যিটা জানুন

করোনা ভাইরাসটি আসলে কি ? করোনা ভাইরাস হলো একধরনের ভাইরাস-পরিবার, যা বহুদিন যাবৎ মানুষ ও বিভিন্ন পশুর দেহে বসবাস করে আসছে। এটি চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আলফা, বিটা, গামা ও ডেলটা। এদের মধ্যে আলফা ও বিটা প্রজাতি মানুষকে সংক্রমিত করে। আর পাঁচটা সংক্রামক রোগের মতোই হাঁচি-কাশি বা স্পর্শের মাধ্যমে এক দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে হ্যাঁ। অতি বিরল হলেও, দু’বার কিন্তু পশু থেকে মানবদেহে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনা ২০০২ সালে। সেবার ভাম বা খটাশ (Civet cat) থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সেটা ছিল SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) নামক একটি শ্বাসনালীর রোগ। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল চীন থেকে। পরের ঘটনা ২০১২ সালের। MERS অর্থাৎ Middle East Respiratory Syndrome। এবারের সূত্রপাত সৌদি আরবে ও মধ্যপ্রাচ্যে। দায়ী ছিল উট। তবে দুটি রোগকেই দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল। এবারের মতো অতিমারীর বা Pandemic আকার নিতে পারেনি।

এবারের কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাও কিন্তু আগের দু’বারের মতো পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত রোগ (Zoonotic disease)। এর শুরুটা ছিল এরকম। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। চিনের উহান থেকে এমন এক ধরণের নিউমোনিয়ার রিপোর্ট পাওয়া যায় যার কারণ অজানা। আক্রান্তের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকে। সন্দেহ করা হয়, উহানের সামুদ্রিক প্রাণীবাজার থেকেই ছড়িয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে সেই বাজার বন্ধ করে দেয় চিন। যদিও রোগটি যে ওই বাজার থেকেই ছড়িয়েছে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।

এর দুদিন পরেই, অর্থাৎ ৩রা জানুয়ারি ২০২০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন ধরনের নিউমোনিয়া সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয় বিশ্বকে। যদিও তখনও নিউমোনিয়ার কারণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ৭ জানুয়ারি জানা গেল, এক নতুন ধরনের করোনাভাইরাস এসেছে। তার নামকরণ করা হলো nCoV, অর্থাৎ নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ (COVID-19, Coronavirus Disease 19 (19=2019)।

তো কিভাবে এই রোগটা ছড়ায়?

চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা জানালেন, হাঁচি, কাশি থেকে ড্রপলেটের মাধ্যমে অর্থাৎ যে লালার ফোঁটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে (droplet infection) তা থেকে সংক্রমণ ছড়ায়। সংক্রমিত হাত বা অন্য কোনও বস্তুর সংস্পর্শে এসে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। মনে রাখবেন, যদি দুজনের মধ্যে দূরত্বটা এক মিটারের বেশি হয় তাহলে কিন্তু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। কেন ? কারণ, এই ভাইরাস একটু ভারি, ফলে বাতাসে খুব একটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে না। এক মিটার যাওয়ার আগেই নিচে পড়ে যায়। তবে বেঁচে থাকে। এক মিটারের মধ্যে মেঝে, টেবিল অথবা অন্য কোনও সারফেসে পড়ে ভাইরাসগুলি গড়ে ৮ ঘন্টা থেকে দু’দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এর মধ্যে যদি সেই জায়গাটি সংক্রমণমুক্ত না করা হয়, তাহলে অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। আবার আক্রান্ত কেউ হয়তো মুখের সামনে হাত রেখে হাঁচলেন বা কাশলেন। সেই হাত দিয়েই তিনি কিছু ধরলেন। কারওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। শুরু হয়ে গেল সংক্রমণ ছড়ানোর প্রক্রিয়া।

তাহলে কিভাবে করোনা ভাইরাস ছড়ানো আটকানো যাবে ?

একমাত্র উপায় যদি ভাইরাস ছড়ানোর চক্রটাকে কোনও এক জায়গায় কেটে দেওয়া যায়। করোনাভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির (উপসর্গ প্রকট না হলেও) সঙ্গে যদি এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখা যায় তাহলে অন্যের দেহে ঢোকার সুযোগ পেল না ভাইরাসটি। বংশবৃদ্ধিও করতে পারল না। লকডাউনের সময় তাই সবাইকে অন্যের থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে সবাই আক্রান্ত। তাই সবাই সবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তাহলেই ধাপে ধাপে চক্র ছিন্ন হতে শুরু করবে।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে গেলে তাহলে কি কি সাবধানতা নেওয়া দরকার?

১) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, বার বার ভালো করে হাত ধুতে হবে। স্যানিটাইজারের দরকার নেই। হাত ধোওয়ার জন্য সাধারণ সাবানই যথেষ্ট। আঙুলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে সময় নিয়ে হাত ধোবেন। অ্যালকোহল বেসড স্যানিটাইজার থাকলে ব্যবহার করতে পারেন। তা নাহলে বেসিনে ট্যাপের নিচে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত দেবেন। মনে রাখবেন রানিং ওয়াটারে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার বিকল্প নেই। হাত না ধুয়ে মুখে, চোখে, নাকে হাত দেওয়া যাবে না। নাক ঝাড়লে হাতটা টিস্যুতে মুছে সেটা ডাস্টবিনে ফেলুন। যেখানে সেখানে ফেললে সংক্রমণের ভয় থাকে।

২) হাঁচি অথবা কাশির সময়ে পাশের দিকে মাথা ঘুরিয়ে নেবেন। নাক ও মুখের উপর রুমাল বা টিস্যু পেপার ধরবেন। এরপর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন। মাস্ক পরে থাকলে সেই অবস্থাতেই হাঁচবেন বা কাশবেন। এরপর মাস্কটা বর্জ্য হিসাবে ডাস্টবিনে ফেলে ভালো করে হাত ধুয়ে নেবেন।

মাস্ক নিয়ে অনেকের বিভ্রান্তি রয়েছে। সুস্থ মানুষের মাস্ক পরার দরকার নেই। যদি তিনি গত দু’সপ্তাহের মধ্যে করোনা আক্রান্ত দেশ বা রাজ্য থেকে আসেন, তাহলে অবশ্য তাঁকে মাস্ক পরতেই হবে। আর যাঁরা সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসছেন যেমন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁদের মাস্ক পরতে হবে। হাঁচি-কাশি-জ্বর-শ্বাসকষ্ট আছে এমন কেউ মাস্ইক পরবেন। এমন উপসর্গযুক্ত রোগীর সংস্পর্শে যদি কেউ আসেন তাহলে তিনিও মাস্ক পরবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের অধিকাংশ লোকেরই মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। আবার এন-৯৫ মাস্কেরও দরকার নেই। সাধারণ মাস্ক হলেই হবে।

৩) জনবহুল জায়গায় যাওয়া যাবে না। গৃহবন্দী থাকুন। জরুরি দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। তাই একসঙ্গে বেশি করে বাজার করে রাখুন যাতে রোজ বাজারে যেতে না হয়। অফিসে বা কাজের জায়গায় যাঁরা আপনার সাথে কথা বলতে আসবেন তাঁদের টেবিলের ওপাড় থেকে কথা বলতে বলবেন। কাউকে কাছে আসতে দেবেন না। নিজে কারওর বাড়িতে যাবেন না। বাড়িয়ে কাউকে আসতেও বলবেন না।

৪) হাতের সরাসরি যোগ থাকা খাবার যেমন, ফুচকা, আলুকাবলি, কাটা ফল খাবেন না। সিগারেটের নেশা থাকলে প্যাকেট সহ কিনুন। পারলে প্যাকেটটা স্যানিটাইজার দিয়ে শুদ্ধ করে নেবেন। খাওয়ার আগে হাত পরিষ্কার করে তবে প্যাকেট থেকে বার করবেন।

৫) সচেতন হোন। অন্যদের সচেতন করুন। মনে রাখবেন, একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের এই ভয়াল বিপদ থেকে রক্ষা করতে। যে দেশের জনসংখ্যা এত বেশি সে দেশে এই মহামারী ঠেকাতে হলে সচেতনতাই একমাত্র অস্ত্র। এখনও যদি আমরা সচেতন না হই তো ভয়ঙ্কর বিপদ সামনে। সরকারকে সহযোগিতা করুন।

সবাই ভালো থাকুন।

তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *