মেমসাহেবের আয়না

কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে সবে ঢুকেছে অসীম। ভূগোল নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছে, পত্র-পত্রিকায় লিখছে টুকটাক । স্কুল কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের  এখন মাঝ পথ । হঠাৎ একদিন নামি ইংরেজি পত্রিকার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে । আবেদন পত্র পাঠিয়ে দিল সে। কয়েকদিন পরে বেমালুম ভুলেই গেল ব্যাপারটা। পড়া চলছিল আপন তালে । একদিন সকালে হঠাৎ ফোন এলো বাড়ির ল্যান্ড লাইনে। ডাক পড়লো সেই পত্রিকার মুম্বইয়ের অফিসে । অসীম তো অবাক!

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রওনা হয়ে গেল সে। ট্রেনে মুম্বই পৌঁছে গেল।  ব্রিটিশ আমলে তৈরি ঐতিহ্যপূর্ণ সেই সংবাদপত্রের অফিস বাড়িতে ঢুকে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল অসীমের । সে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, এটা বাস্তবে ঘটছে, আদতে স্বপ্ন নয়। দীর্ঘ কথাবার্তা আর একটা ছোট্ট পরীক্ষা দিয়ে রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করে দিলো অসীম । কাজ করতে হবে নিজের রাজ্যে। অবশ্য পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত কাজ শেখার সময় দেওয়া হল তাকে, অনেকটা ইন্টার্নশিপের মতো, অল্প স্বল্প কাজ করতে করতে হাতে কলমে কাজ শিখে নিতে হবে , অফিসের এমনটাই নির্দেশ।

এমন একটা মজার অনুসন্ধিৎসু কাজ পেয়ে একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার দশা অসীমের। উত্তেজনায় নিজেকে যেন ফেলুদা মনে হচ্ছিল। রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকদিন। কিন্তু  কাজটা যে কিভাবে শুরু করবে এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না সে । কলকাতার অফিসে নিয়মিত সিনিয়রদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে একটু একটু করে কাজ আরম্ভ করে অসীম।  কাজ করতে শুরু করে পড়াশোনার পাশাপাশি। একসময়  পড়া শেষ হয় অসীমের । কাজটাও একটু একটু করে রপ্ত হতে থাকে। প্রত্যেকটি রিপোর্টিংয়ে যেন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা।

এক রকম ভালো মন্দ মিশিয়েই চলছিল অসীমের। এই রকমই এক শরতের সকাল। সূর্যের তাপ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। আকাশে মেঘেরা নিজের ছন্দে বয়ে চলেছে । পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায় । ঘুম থেকে উঠে একটু শরীরের কসরৎ করা অসীমের ছোট থেকে অভ্যেস। ছোটবেলার অভ্যাস এখনো জারি আছে । এমনই এক সকালে শরীর চর্চা করে স্নান সেরে চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজে সবে চোখ রেখেছে অসীম ; বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোন বেজে উঠলো। দুবার রিং হতেই গভীর গলায় হ্যালো বললো অসীম। অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া এলো ,অসীম বাবুকে পাওয়া যাবে? অসীম বলল,’ বলছি ‘। আমি ব্যারাকপুর রায়পাড়া আইসি তপন বাগচী বলছি । এখানে একটা বড় ডাকাতি হয়েছে, একবার চলে আয় । একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে আর বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা  যাবে । অসীম বলল, আরে তপনদা যে ,মজা করছ ! দাঁড়াও আসছি ,।ফোন রেখেই চা একঢোকে শেষ করলো অসীম । তার পর জামা প্যান্ট বদলে নিজের এনফিল্ড বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে । নিজের কোয়ার্টারে বাইরের লনে বসে, কয়েকজন কনস্টেবল এর সঙ্গে কথা বলছিলেন তপনবাবু । হাত পা নাড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে । বাইক এক পাশে দাঁড় করিয়ে লন ধরে এগিয়ে আসছিল অসীম। তপনবাবু চেয়ার থেকে উঠে এসে বলল ,আয় আয় অসীম। দেখ! কি কান্ড ! আধ ঘণ্টা আগে ফোন এলো রায়পাড়ার হরিহরণ রায়ের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে । চল তোকে নিয়ে যাই , এক সঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। গাড়িতে ওঠা মাত্র গাড়ি ছুটলো হরিহরণ রায়ের বাড়ির দিকে।

অসীম জিজ্ঞাসা করল,’ কি হয়েছে তপনদা ‘ । তপন বাগচী  কলেজে অসীমের দু’বছরের সিনিয়র । একই ডিপার্টমেন্ট । সদ্য দায়িত্ব পাওয়া তপন বেশ কর্মোদ্যোগী প্রাণোচ্ছল ও ডাকাবুকো । আইসি হয়ে আসা ইস্তক   চোর দুষ্কৃতীদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। তপনবাবু বললেন , সকাল পাঁচটায় ফোন এসেছে ,হরিহরণ রায়ের বাড়িতে চুরি হয়েছে আর একজন চাকরকে খুন করা হয়েছে। খুব মূল্যবান একটি আয়না নাকি চুরি গেছে।  হরিহরণবাবুর ছোট ছেলে ফোন করেছিলেন।পুজো উপলক্ষে তিনি বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরেছেন গতকালই। আর আজ ভোর রাতেই নাকি এই ঘটনা । চল দেখা যাক !

 
কথা শেষ হতে না হতেই পুলিশের জীপ দাঁড়ালো রায়পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বিশাল লোহার গেটের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে তপনবাবু ,দুজন কনস্টবল ও অসীমকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন । লাল মোরাম এর রাস্তার দু’পাশে  কেয়ারি করা বাগান । তারপর বিশাল আকৃতির   নীল রঙের পুরনো দিনের আদলে তৈরি বাড়ি । পাশের একটি দালানে ঠাকুর গড়ার কাজ চলছে । বাড়ির সামনের দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু আইসি তপনবাবু কলিং বেল বাজালেন। বেরিয়ে এলো জিন্সের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও হলুদ রঙের টি-শার্ট পরা বছর চল্লিশের একজন সুপুরুষ। তপনবাবুকে নমস্কার করে জানালেন , তিনি হরিহরণবাবুর ছোট ছেলে রমিত । তিনিই ফোন করেছিলেন। তাঁদের ড্রইং রুমে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন । ছিমছাম সাজানো ড্রয়িং রুম । সোফা কোচ ৩টি ,  টিভি দেয়ালে লাগানো আর পাশে সাউন্ড সিস্টেম সাজানো। অন্যদিকে দেওয়ালে পুরানো দিনের দেওয়াল আলমারি বেশ কারুকার্য করা ।আলমারিতে বই সাজানো থরে থরে ।পুরানো দিনের বাড়ি রেনোভেট করা হয়েছে । দুদিকের জানলা দিয়ে সুন্দর হাওয়া আসছিল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছিলো অসীম ।এর মধ্যে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া রাশভারী এক বৃদ্ধ এসে তপনবাবু কে নমস্কার জানিয়ে সোফায় বসলেন। রমিত বললেন, ইনি আমাদের বাবা হরিহরণ রায় । রায়মশাই অসীমের দিকে তাকালেন। তপনবাবু জানিয়ে দিলেন, ইনি নামি ইংরেজি পত্রিকার রিপোর্টার অসীম মুখোপাধ্যায় । এবার হরিহরণবাবু অসীমকে নমস্কার জানালেন। বললেন দেখুন যদি কিছু করা যায়।


এবার শুরু করলেন হরিহরণবাবু। আমাদের এই বাড়ি আমার ঠাকুরদার বাবা রামহরি রায় বানিয়েছিলেন । উনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী । অফিসের কাজের সঙ্গে ইন্টারপ্রেটার এর কাজ করতেন। তিনি শেষ বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে এখানে বসবাস শুরু করেন। তখন এদিকটায় কোন জনবসতি ছিল না । দূরে দূরে দু একটা  বাড়ি  তৈরি হয়েছিল।  চারিদিকে ফাঁকা ।  রামহরি  বাড়ি তৈরীর পর বেশি দিন বাঁচেননি । তাঁর চার মেয়ে এক ছেলে ছিল । তিনিই আমার ঠাকুরদা। ঠাকুরদা হরিকিশোর রায়ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সঙ্গে সোনার ব্যবসা শুরু করেন তিনি ।সেই সময় এক ইংরেজ সাহেবের বিশেষ লোক ছিলেন তিনি।  রেল তৈরির সময় তিনি শিয়ালদায় নানান দায়িত্ব সামলেছিলেন । চাকুরীর সঙ্গে ব্যবসাটাও বেশ জাঁকিয়ে শুরু করেছিলেন।  ঢাকা থেকে এক নামি স্বর্ণকার এনে গহনার ডিজাইন করে বানাতেন । সেই জিনিস  নাকি বিভিন্ন জমিদার বাড়িতেও যেত।  সেই ইংরেজ সাহেবের স্ত্রী অ্যানি একদিন ঠাকুরদার কাজের প্রশংসা শুনে দোকানে এসেছিলেন। তিনি একটি সোনার আয়নার অর্ডার দেন। বেলজিয়াম কাচের হাত আয়না । একটি দামি হীরে বসানো হয়েছিল । আয়নার মাথায় চারপাশে পান্না  সহ নানান দামি মনি মুক্ত বসানো হয়েছিল এই হাত আয়নায়। সেই আয়নাটি নাকি মেমকে উপহার দিয়েছিলেন ঠাকুরদা । এরপরে ঠাকুরদার কাজের উন্নতি হয়েছিল তরতড়িয়ে। ইতিমধ্যেই আমার বাবা ও দুই পিসি বড় হচ্ছিল।  এই বাড়ির সব আসবাবপত্র সেই সময়ে বানানো হয়েছিল।  বাবার কাছে শুনেছি একজন কাঠের মিস্ত্রী নাকি বাড়িতেই থাকতেন বারো মাস । সব মেহগনি কাঠ দিয়ে বানানো।  এইসব আসবাবপত্রের এমন সূক্ষ্ম কাজ আর এমন টেকসই জিনিস এখন কোথায় পাবেন! মাঝেমধ্যে পালিশ করে নিলেই হল। আবার নিজের মহিমায় ফেরে ।

অসীম দেখে নিচ্ছিলো বইয়ের আলমারি, সোফা, টেবিল, কর্নার টেবিল। সর্বত্রই যেন ঐতিহ্যের ছোঁয়া মাখা । হরিহরণবাবু ফের বলতে শুরু করলেন। সেই মেম কোন বিশেষ কারণে দেশে ফিরে গেলেন। যাবার আগে এলেন আমাদের বাড়িতে দেখা করতে।  লাল ভেলভেট’-এর একটা ব্যাগ মায়ের হাতে ধরিয়ে বললেন এটা তুমি রেখে দাও।  চলে যাওয়ার পর মা খুলে দেখল যে সেই সোনার আয়না ।বাবাকে দেখাতেই অবাক। এটাতে অবশ্য মা খুব খুশি হয়েছিল।  আমি চাকরি কোনদিন করিনি ।পারিবারিক সোনার ব্যবসা করেছি। বড় ছেলে রোহিত এমবিএ পড়ে এই ব্যবসাতেই যোগ দিয়েছে । ওর উদ্যোগে কলকাতার বাইরে দুর্গাপুর, বারাসাত ,কাটোয়া সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের দোকানের শাখা হয়েছে এখন। গুণী শিল্পীরাই আমাদের গহনার ডিজাইন থেকে মেকিং করে থাকেন। পারিবারিক ভাবেও তারা বংশানুক্রমিকভাবে রয়ে গেছেন আমাদের সঙ্গে । তবে নতুনদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে । দেখাশোনা বড় ছেলে রোহিতই করে থাকে । আর ছোট ছেলে রমিত ডাক্তার। লন্ডনে পড়াশোনা করে সেখানেই হার্টের নামকরা ডাক্তার এখন।

হরিহরণবাবু বলে চলেন। সেই সোনার আয়না টির দাম কয়েক কোটি টাকা । এই আয়না আমাদের ঘরে লকারে রাখা থাকে।  এমন একটা জিনিস আর তৈরি হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। ওটা বয়েসের দিক থেকে অ্যান্টিক । আয়নার কথা আমাদের পরিবারের সবাই জানে কিন্তু পরিবারের বাইরে কেউ জানে না । অসীম এতক্ষণ নোটবুকে একমনে নোট নিচ্ছিল। মাথা তুলে বলল , বাড়িতে যারা কাজ করে তারা কি বিষয়টা জানে? এবার রায়মশাই অসীমের দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে, একটু গুছিয়ে  বসে বললেন,  হ্যাঁ ওরা জানে। তবে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই । আমাদের পরিবারের সোনার ব্যবসা । সোনার গহনা পত্র বিভিন্ন সময় বাড়িতে এনে রাখা হয় তাই বিশ্বস্ত কাজের মানুষ ছাড়া আমরা বাড়িতে কাউকে রাখি না। তবে সব গহনা পত্র উপরে একটি নির্দিষ্ট ঘরে থাকে।  সেই ঘরে কেউ যায় না।  বাড়ির মেয়েরাই ওই ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকে । ওই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না । ওই বিশেষ ঘরটিতে আমাদের বাড়ীর পুরোনো লকার  আছে।  তাছাড়া আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করেন তারা সকলেই পুরনো এবং বিশ্বস্ত। 
আর দু সপ্তাহ পরে পুজো। তাই ছোট ছেলে বাড়ি এসেছে।  লক্ষ্মীপুজোর পরে আবার ফিরে যাবে । রমিতের একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়ে সিক্সে পড়ে আর ছেলে ক্লাস টুতে । আমার বড় ছেলে রোহিতের একটি মাত্র ছেলে, সে কলেজে পড়ছে । বড় বৌমা ও ছোট বৌমা দুজনেই হাউস ওয়াইফ । আর ওদের মা গত হয়েছে দু বছর আগে ।

তপন বাবু বললেন , চলুন একবার চুরির জায়গাটা দেখে আসি।  রায়মশাই এবার উঠলেন ,বললেন চলুন । ইতিমধ্যেই কখন যেন তার বড় ছেলে রোহিত এসে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন,  রোহিতবাবুই আইসি তপনবাবু ও অসীমকে সঙ্গে  করে সেই ঘরে তাদের নিয়ে গেলেন । যেখানে রায় পরিবারের রহস্য লুকিয়ে থাকে। পুরানো দিনের আদলে তৈরি বাড়িতে , বৈঠক খানা থেকে একটা লম্বা করিডর  চলে গেছে । তার দুপাশে ছটি ঘর। একটি রান্নাঘর অন্যটি ভাঁড়ার-ঘর, বাকি দুটো তে বাড়ির ৬  জন  কাজের লোক থাকে । বাকি  দুটি ঘর তালা মারা । করিডর যেখানে শেষ সেখান থেকেই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।  ঈশাণ কোনের ঘরটি যেতে উপরের চারটি ঘর পেরিয়ে যেতে হয় । সিঁড়ির মুখে পুরানো দিনের শোয়ানো লোহার দরজা।  চারিদিকে আভিজাত্যের প্রতিফলন । এই ঘরটির সামনেও লোহার দরজা । দরজায় তালা সব সময় দেওয়া থাকে। চাবি থাকে রায়মশাই এর ঘরের লকারে । তালাটি তখনও চাবি সহ দরজার সঙ্গে ঝুলছে।  ভিতরে বেশ কয়েকটি আলমারি। একটি পুরনো দিনের গোদরেজের লকার আর ঘরের এক কোণে সিঙ্গেল একটা খাট । রহিতবাবু বললেন ,এই ঘরে কেউ থাকেনা । জিনিসপত্রের হিসাব পত্র রাখার জন্য কর্মীরা তক্তা বসে বসে হিসেব করে । আলমারি গুলিতে সামান্য কিছু গহনা মজুত থাকে সারা বছরই, কিন্তু কিছুই চুরি যায়নি। কেবলমাত্র বহু মূল্যের ওই আয়নাটিই খোয়া গেল।

তপন বাবু বললেন ,লকার বন্ধ না করেই বেরিয়ে গেছে। মাটিতে চাবিটা তখনো পড়ে আছে।  কনস্টেবল সামন্ত বাবু চাবিটি সাদা গ্লাভস পরে তুলে নিলেন একটা প্লাস্টিকের মধ্যে ।  ঘরের মাঝখানে তখনও ডেড বডিটা পড়ে রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বডি চলে গেল পোস্টমর্টেমের জন্য।  বিভিন্ন জায়গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও সংগ্রহ করা হলো । আর কিছুক্ষণ ওখানে নিরীক্ষণ করে ওরা নিচে নেমে এলো । গাড়ির কাছে যাবে ঠিক এমন সময় একটা দামি বিদেশি গাড়ি হাই স্পিডে এসে দাঁড়ালো গেটের কাছে । নামল কুড়ি একুশ বছর বয়সের একটি ছেলে ।মাথার চুল লাল রঙের, বিশেষ স্টাইলে কাটা ।পড়নে টি-শার্ট কার্গো প্যান্ট। বেপরোয়াভাবে বাড়িতে ঢুকলো । তপনবাবু দেখে থমকালো ,একটু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখছিলেন । রায় মশাই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসছিলেন , বললেন, আমার বড় নাতি রিকি । সকালে জিমে যায়।  উঠতি বয়সের ছেলে তো ! বুঝতেই পারছেন কোন কিছুই প্রভাব ফেলে না  ওদের।  রমিত বললেন,  রতন খুন হল । সে বড় বিশ্বস্ত ছিল,  দেখবেন যেন এর একটা বিহিত হয় ।

বাড়ির পুরনো ছবি থেকে আয়নার ছবি মোবাইলে তুলে নিল অসীম। থানায় এসে রহস্যের কি কি সমাধান হচ্ছে তা যেন তাকে জানানো হয়, একথা বলে সে নিজের এনফিল্ড বাইক টি নিয়ে এলাকা ছাড়লো। ছবিটি নিয়ে তার পরিচিত এক জহুরীর দোকানে গেল সে। জহুরী যা বলল তাতে অসীম অবাক! এই আয়নার বাজার দর নাকি কোটি টাকা, কারণ আয়না টি এক ফুট এর সম্পূর্ণ রূপো দিয়ে তৈরি, দামি বেলজিয়াম কাঁচ, তাতে আবার হিরে জহরত বসানো আছে। এছাড়াও এটি একটি দুষ্প্রাপ্য জিনিস সময়ের হিসেবে। চাকরকে কেন খুন করা হলো? নিশ্চয়ই বাধা দিতে গেছিলো, এইসব নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে অসীমের।

খবর পাঠিয়ে রাতে ঘুমোতে যেতে দেরি হয়েছিল অসীমের। সকালে শরীর চর্চা করে স্নান করতে গেল। স্নান সেরে ব্রেকফাস্টে মায়ের হাতের গরম গরম ডালপুরি আর ঘন ছোলার ডাল  সঙ্গে সন্দেশ, সবে খেতে বসেছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। মা এসে বলল, অসীম দেখ তপন এসেছে। তপন তুমি বস। গরম গরম ডালপুরি বানাচ্ছি খেয়ে যাবে। অসীম এর ডাক নাম সোম। তপন বলল, না না মাসিমা আবার এসব কেন? অসীমের মা বলল, কোন কথা নয়, তোমাদের যা কাজ, হাতের কাছে আজ পেয়েছি, না খাইয়ে ছাড়ছি না। অসীমের মা ভিতরে চলে গেল। অসীম বলল, তপন দা কিছু পেলে? তপন বাবু বললেন, শোন না, এই জন্যই এসেছি। মনে হচ্ছে বাড়ির ভিতরের লোকই করেছে কারণ বাড়ির লোক ছাড়া এমন একটা কাজ বাইরের লোকের পক্ষে করা কখনই সহজ নয়। অসীম বলল, তা তুমি কাকে সন্দেহ করছো? তপন বলল, খোঁজ নিয়ে দেখলাম ওদের বাডি়তে মালির কাজ করে যে তাকেই সন্দেহ হচ্ছে। মালিটি বাগান পরিচর্যা করা ছাড়াও সকলের ফাইফরমাশ খাটা, বাজার-টাজার যায়। যে দিন সকালে চুরি হয়েছে তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা সে অনেকক্ষণ বাড়িতে ছিল না। আবার সকাল থেকেও কোথায় যেন গেছিল। আমরা ওখানে পৌঁছানোর আগে বাড়ি ফিরে এসেছে। অসীম বলল, চলনা একবার ঘুরে আসি। খাওয়া শেষে তারা গেল রায়বাড়িতে। পরিবেশ বেশ থমথমে। তপন আর অসীম প্রথমেই চাকরদের সঙ্গে কথা বলল। সকলেই নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের হাজারো প্রমান দিলো। মালিকে জেরা করে জানা গেল, শিয়ালদায় অসুস্থ দাদাকে দেখতে গেছিল। বাড়ির বাকিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাত অসীম রোহিতকে বলল, চলুন একবার আপনার ছেলের ঘরটা দেখে আসি। এটা শুনে রোহিত একটু কড়া নজরে অসীমের দিকে তাকালো। বলল, আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আপনি আমার ছেলেকে সন্দেহ করছেন? পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেখে তপন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আরে আরে আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সবটাই তো দেখতে হবে। যাক আমরা আসি।

অসীম খুব চুপচাপ। গাড়িতে উঠে তপন অসীমকে বলল তুই কি কিছু সাসপেক্ট করছিস অসীম? সে বলল, আমাকে একটু সময় দাও তপনদা। তোমাকে বলবো। শুধু তোমার কাছে কয়েকটা সাহায্য লাগবে। সেগুলো করবে কিনা বল? তপন বলল, আলবাত করব। নামার আগে অসীম বলল, মোবাইলটা যেন বন্ধ না হয়। যখন তখন ফোন করতে পারি। তপন বলল, ঠিক আছে তুই তোর মত সন্ধান কর, আমি আমার মত।

অসীমের যখন ফোন এলো তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা। ফোন তুলে তপন বলল, বল অসীম। সে তাড়াহুড়োয় বলল, তোমাদের সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টটা কোথায়? অসীমকে একটা ফোন নম্বর দিল তপন। তারপর ফোন কেটে গেল। আবার সাড়ে সাতটায় ফোন এলো। তপনদা তুমি সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে চলে এসো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তপন বলল শিকদারের অফিসে? অসীম বলল, হ্যাঁ। ফোন রেখে ১০ মিনিটে তপন পৌঁছে গেল শিকদারের অফিসে ।অসীম বলল, চলো চলো অনেক কিছু বলার আছে। অসীম, তপন আর মিস্টার শিকদার প্রায় আড়াই ঘন্টা কম্পিউটারের সামনে বসে অনেক কাজ করল। তারা অনেক জনকে ফোন করলো। কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে অসীম আর তপন চলে গেল অন্য একটি ঘরে। আর শিকদার বেরিয়ে গেল ফোর্স নিয়ে। তপন আর অসীম দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পরে যখন ঘর থেকে বেরোলো তখন ভোর সাড়ে তিনটে। তপনবাবু ড্রাইভারকে বললো, গাড়ি বের করো।

অসীম ও তপন যখন রায়বাড়িতো পৌঁছালো, তখন ঘড়ির কাঁটা ভোর চারটে। শরতের ভোরে হালকা শীতের আমেজ। রাস্তার মোড়ে কুকুরগুলো গুটিয়ে শুয়ে আছে। কোথা থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশ এখনও পরিষ্কার হয়নি। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে। চারিদিকে শান্তির নিস্তব্ধতা। গাড়ির আওয়াজ শুনে কুকুরগুলো মাথা উঁচু করে দেখে আবার শুয়ে পড়ল। রায়বাড়ির দরজায় কলিং বেল বাজানোর বেশ কয়েক মিনিট পর বাড়ির মালি এসে দরজা খুলে দিল। মালির পিছু পিছু এসে দাঁড়াল রমিত। তপনবাবু বললেন, বাড়ির সকলকে একবার নিচে আসতে বলুন।

সকলে বৈঠকখানার ঘরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তপনবাবুর দিকে। তপন বলতে শুরু করল। রহস্যের কিনারা যে এত তাড়াতাড়ি করতে পেরেছি তা আমার এই ভাইটির জন্য। তপন রায়মশাইয়ের দিকে ঘুরে বললো, আপনার কপাল ভালো যে এত তাড়াতাড়ি আমরা ব্যাপারটার খোঁজ পেলাম। নইলে তো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্ত টাকাও হাপিশ হয়ে যেত। হরিহরণবাবু বললেন, মানে? তপন বলল, সেটাই তো বলছি। কলকাতায় বেশ কয়েকদিন ধরে একটা বড় সাইবারক্রাইমের টিমের খোঁজ করছিলাম আমরা। বড়লোক বাড়ির ছেলেরাই ওদের টার্গেট। তাদের মেইল অ্যাড্রেস জোগাড় করে ওরা ফাঁদ পাতে আর খুব সহজেই ফাঁদে পা দেয় ছেলেরা। তেমনই একটি চক্রের পাল্লায় পড়েছে আপনার বড় নাতি রিকি। কয়েকদিন আগে ওদের দেওয়া একটা গেম রিকি খেলতে শুরু করে ১৫ দিন আগে থেকে। গেম শুরু হওয়ার পর থেকে ওরা রিকিকে ৩ লক্ষ টাকা জমা দিতে বলে। রিকি নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকা ওদের দিয়ে দেয়। পুরস্কার হিসাবে ১৫ লক্ষ টাকা পায় রিকি। রিকির লোভ বাড়ে। এবার ৫০ লক্ষ পুরস্কারের জন্য ওরা জমা দিতে বলে ২০ লক্ষ টাকা।

তপনবাবু বলে চললেন। আমরা রিকির ফোন ট্যাপ করে জানতে পারি, ওর কাছে এত টাকা নেই। ওরা রিকিকে লোভ দেখাতে থাকে। টাকার বদলে দামি অন্যকিছু দিলেও পুরস্কার পেতে অসুবিধা হবে না বলে জানায়। তখনই রিকি ওদের অ্যান্টিক আয়নাটির কথা বলে। আয়নার বাজারমূল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওই দলের লোকেরাই আয়নাটি চুরি করে আনার পরামর্শ দেয়। কিন্তু রিকি কতটা কাজটা পারবে তা নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় ওরা নিজেরাই আয়নাটি চুরি করার পরিকল্পনা করে। ওদের দলের সর্দার নিজেই এসেছিল এই বাড়িতে চুরি করতে। রিকিই সদর দরজা খুলে দেয়। লকারের চাবিও সেই জোগাড় করে ওদের হাতে তুলে দেয়। কোন কারণে সেই সময় রতনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে ওদের পিছনে ধাওয়া করতে গেলে ওকে ছুরি মেরে বেরিয়ে যায় ওরা। এভাবে হঠাৎ একজন খুন হয়ে যাওয়ায় তড়িঘরি পালিয়ে যায় ওরা। তাই লকার ও দরজায় তালা দিতে পারেনি। রিকিই ওদের গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসে ওদের ডেরায়। মনে করে দেখুন, সেদিন সকালে যখন আমরা আসি, সাড়ে আটটার সময় গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরে রিকি। আমরা ওর জিমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ও সেদিন জিমে যায়নি। আর সব থেকে বড় কথা হল, ওরা রিকিকে আয়নার দাম ১৫ লক্ষ টাকা বলে। অথচ বাজারে যার দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাকি টাকার জন্য রিকি আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস দেবে বলেছিল। ওই দলের পান্ডাকে গত রাতে হাতেনাতে ধরেছেন মিস্টার শিকদার। সে জেরায় সব স্বীকার করেছে। উদ্ধার হয়েছে আয়নাটিও।

তপন বলেন, রিকির বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিকির গতিবিধি নিয়ে প্রথম সন্দেহ হয় অসীমের। আমায় বলে ও। তারপরে আমরা সবাই মিলে লেগে পড়ি ঘটনার কিনারা করার জন্য। সব শুনে রহিত মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছেন কখন তা কেউ টের পাননি। রিকি দাঁড়িয়ে আছে জানলার দিকে মুখ করে। নির্বাক হরিহরণবাবু। আয়না ফিরে পাওয়ার আনন্দ তখন হার মেনেছে নাতির কৃতকর্মের কাছে। রহিতকে অসীম ধরে মেঝে থেকে তুলে বসিয়ে দিল সোফায়। বলল, চিন্তা করবেন না। ভালো উকিল দিলে রিকি দ্রুত জামিন পেয়ে যাবে। তপনবাবু এক কনস্টেবলের হাতের ব্যাগ থেকে আয়নাটি বের করে তুলে দিলেন হরিহরণবাবুর হাতে। রিকিকে নিয়ে গিয়ে তুললেন পুলিশের জিপে।

সূর্য্য উঠে গিয়েছে। নতুন দিনের শুরু। ফোন বেজে উঠল অসীমের। রিং টোনে শোনা যাচ্ছে ‘বাজল তোমার আলোর বেনু’ ।  স্ক্রিনে মায়ের নম্বর ভেসে উঠেছে। লুচি আর আলুর দম রেডি করো। এখনই আসছি। বলতে বলতেই দৌড়ে উঠে গেল তপনদার গাড়িতে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!