বিরলতম রোগের সাতকাহন

‘ভুল ভুলাইয়া’ সিনেমাটি অনেকেই দেখেছেন। এটি একটি হিন্দি ছবি। কিভাবে এক তরুণী ইতিহাসের কোনও চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে গুলিয়ে ফেলে সেই চরিত্রের মতো আচরণ করতে শুরু করে, সেই ছবি তুলে ধরেছেন পরিচালক প্রিয়দর্শন। আসলে এটি একধরণের মানসিক সমস্যা। মেডিক্যাল সায়েন্সে যাকে বলে, ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার’। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, আধুনিক যুগের এক তরুণী এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে নিজেকে কিভাবে বহুদিন আগে মৃত এক নর্তকী মনে করতে শুরু করে। চিকিৎসকেরা বলেন, এটি এক বিরল রোগ। তবে বিরলতম নয়।

অক্টোবরের (২০১৯) মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান মেডিকেল কলেজে এমন এক রোগী এসেছিলেন, গত একশো বছরে সারা বিশ্বে তেমন নাকি মাত্র ১১ টি ‘কেস’ পাওয়া গিয়েছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি হাসপাতালের সার্জেন নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে আসেন শহর লাগোয়া নেড়োদিঘির বাসিন্দা বছর তেইশের শেখ রফিকুল ইসলাম। তাঁর দাবি, প্রস্রাবের সঙ্গে ভাত বার হচ্ছে। প্রথমে মেডিকেল কলেজের প্রায় সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রোগীর এমন উপসর্গের কথা শুনে। পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাঁকে ভাত খাওয়ানো হয়। দেখা যায়, রফিকুল মিথ্যা বলছেন না। ভর্তি করে নেওয়া হয় তাঁকে। পরীক্ষা নীরিক্ষার পরে জানা যায়, বিরলতম রোগ ‘ইউরেটেরো ডিওডেনাল ফিসচুলা’য় আক্রান্ত রফিকুল। দশ জন চিকিৎসকের একটি দল তাঁর অস্ত্রোপচার করে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান রফিকুল।

রফিকুল জানান, আট বছর বয়সে প্রসাব দিয়ে প্রথমবার ভাত বেরোতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। খাবার পরে প্রস্রাব করলেই ভাত বা অন্য খাদ্যবস্তু বেরিয়ে আসত। একবার নয়, বার বার এমন হয়। সঙ্গে মূত্রনালিতে জ্বালাপোড়া। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেননি। বরং, তাঁর মানসিক সমস্যা রয়েছে বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ইদানিং তাঁর সমস্যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বর্ধমান মেডিকেল কলেজে তাঁর রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানান, রফিকুলের খাদ্যনালিতে ফুটো ছিল। খাদ্যনালীর নীচের অংশ ‘ডিওডেনম’ থেকে কোনও ক্রমে একটি সরু নালা তৈরি হয়ে কিডনির ‘ইউরেটর’ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেই নালা ধরেই খাদ্যবস্তু পৌঁছে যাচ্ছিল মূত্রথলিতে। আট বছর বয়সে রফিকুলের প্রস্রাবের সঙ্গে নাকি বড় কৃমি বেরিয়ে এসেছিল। তারপরেই সমস্যার শুরু। চিকিত্‍সকদের অনুমান, ওই কৃমিই খাদ্যনালী ফুটো করে মূত্রনালীতে চলে গিয়েছিল। সেই ফুটোই ধীরে ধীরে ফিসচুলায় পরিণত হয়। ১৫ বছর ধরে ভোগার পরে এতদিনে সুস্থ হলেন রফিকুল।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও এক বিরলতম রোগের কথা প্রকাশ্যে আসে। ঘটনাটি আরও দু’বছর আগের। আমেরিকার ওরেগনের ব্রুকিংস শহরের বছর চব্বিশের ছটফটে তরুণী অ্যাবি বেকলি মাঝে মাঝেই ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়, জঙ্গলে ঘুরে বেরাতে যেতেন। সেবার ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফেরার পরে একটা চোখ নিয়ে সমস্যায় পড়েন। সবসময় করকর করে। জলের ঝাপটা দিয়ে লাভ হয় না। চুলকেও লাভ হয় না। এক দিন খুব অস্বস্তি হওয়ার সময় চোখের মণি থেকে কি একটা সুতোর মতো প্রায় আধ ইঞ্চি লম্বা জিনিস টেনে বের করে আনলেন। ঘাবড়ে গিয়ে গেলেন চিকিৎসকের কাছে। তিনি চোখ থেকে আরও দুটি সুতোর মতো জিনিস বের করলেন। চিকিৎসকেরা ভালো করে পরীক্ষা করে জানতে পারেন, এগুলো বিশেষ এক ধরণের কৃমি। চিকিৎসকেরা মোট ১৪ টি এমন কৃমি বের করেছিলেন অ্যাবির চোখ থেকে। তারপর থেকেই চোখজ্বালা বা করকর করার উপসর্গ উধাও।

চিকিৎসকেরা গবেষণা করে জানতে পারেন, পরজীবীগুলি হল ‘থেলাজিয়া গুলোসা’। যা সাধারণত থাকে গরুর চোখে। কখনও বেড়াল বা কুকুরের মতো প্রাণীদের চোখেও দেখা যায়। বিশেষ এক ধরণের মাছি চোখের জল খেয়ে বেঁচে থাকে। ওই সব পশুর চোখে বসা মাছির মাধ্যমে চোখে চলে যায় কৃমির লার্ভা। সেখানেই বাড়তে থাকে সেগুলি। অ্যাবি জানান, ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন গো-পালন কেন্দ্রের কাছাকাছি। ঘোড়ায় চড়ে ঘোরার সময় হঠাৎ একটি মাছি তাঁর চোখে এসে পড়ে। চোখের পলক পরার আগেই। মানুষের চোখে থেলাজিয়া ফ্যামিলির কৃমির ঘটনা বিশ্বে প্রায় ১৭০ বার ধরা পড়েছে। তবে ‘থেলাজিয়া গুলোসা’ বিশ্বে এটাই প্রথম, দাবি চিকিৎসকদের।

বর্ধমান মেডিকেল কলেজে আরও এক বিরলতম রোগীর দেখা মিলেছিল ২০০২ সালে। বীরভূমের এক গ্রামের ১৩ বছরের কিশোর চন্দন গোস্বামীর প্রস্রাবদ্বার দিয়ে মাছি বেরোচ্ছিল। চিকিৎসকেরা প্রথমে ভেবেছিলেন, ইউরিনারি ট্রাক্টের ভিতরে হয়তো কোনওভাবে বাসা বেধে রয়েছে মাছির লার্ভা। সেকথা ভেবে সিস্টোস্কোপি করে ইউরিনারি ট্রাক্ট সাফ করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরদিন ফের দুটি মাছি বেরিয়ে আসে। এরপরেই আরও পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু করেন চিকিৎসকেরা। জানা যায়, চন্দন ‘মাইয়াসিস’ উপসর্গে আক্রান্ত। বিশেষ ধরণের মাছির লার্ভা শরীরে কোনও ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটলে এমন সমস্যায় আক্রান্ত হয় রোগী। মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পশুদের মধ্যে মূলত এই উপসর্গ দেখা যায়। মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ার ঘটনা বিরল। মাছির ডিম ভিতরে প্রস্ফুটিত হওয়ার পরে লার্ভা শরীরে যে কোনও ছিদ্র, মিউকাস মেমব্রেন এমনকি মুখ দিয়েও বেরিয়ে আসতে পারে। এরপর তা মাছির আকার লাভ করে। চন্দনের ক্ষেত্রে মাছি হয়েই সেগুলি বেরিয়ে আসছিল। আর তাই বেরিয়েই উড়ে যাচ্ছিল মাছিগুলি। চিকিৎসকদের মতে, মাইনর সার্জারি করে ত্বকের নীচ থেকে ম্যাগটগুলি বের করে দেওয়া যায়। কিন্তু এভাবে সম্পূর্ণ মাছি বেরিয়ে আসার ঘটনা ছিল বিরলতম।

তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিরলতম রোগ বোধ হয় ‘ফিল্ডস ডিজিজ’। সারা পৃথিবীতে এখন এই রোগে আক্রান্ত রয়েছেন মাত্র দু’জন। অস্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলসের দুই যমজ বোন, ক্যাথরিন ফিল্ড ও ক্রিস্টি ফিল্ড। বস্তুত, তাঁদের নাম থেকেই রোগটির নামকরণ করা হয়েছে। মাত্র চার বছর বয়সে দুই বোন এক সঙ্গে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে তাঁরা কথা বলেন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই রোগে সারাদিন ধরে ঘন ঘন ‘মাসল স্পাজম’ হয়। কোনও কিছু দিয়েই তা আটকানো যায় না। আবার স্পাজম বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তীব্র ‘মাসল পেন’। প্রতি সাড়ে ৩ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে একজনের হতে পারে এই রোগ। তাই সবচেয়ে বিরলতম রোগের তকমা পেতেই পারে ‘ফিল্ডস ডিজিজ’।

Leave a Comment

error: Content is protected !!