You are currently viewing মালগাড়ির কেবিনে সেদিন

মালগাড়ির কেবিনে সেদিন

অর্পিতা মজুমদার

‌রূপা বহুদিন পর আবার পুরুলিয়া চলেছে মালগাড়ি নিয়ে। গত দশ বছর ধরে সে এই কাজই করে চলেছে। কলেজে পড়তে পড়তে চাকরি পায়, ‘গুডস্ ট্রেন গার্ড’। এই চাকরি নিয়ে বাড়ির সকলের অমত ছিল। কিন্তু রূপা দমেনি। চিরকাল পাড়ায় ডানপিটে নামেই পরিচিত। কোথায় ভলি, কোথায় কবাডি, সব জায়গায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। দেখতে যদিও খুব সাধারণ।

‌মামা বাড়ির পাশ দিয়ে যখন ট্রেন গুলো ঝুকঝুক করে পেরিয়ে যেত তখন থেকে স্বপ্নটা মনে বপন করেছিল রূপা। পরীক্ষা দিয়ে পেয়ে গেল চাকরি ‘মালগাড়ির গার্ড’। কিছু দিন ট্রেনিং করার পর প্রথম যেদিন মালগাড়ি নিয়ে রাঁচি যাচ্ছে, সেদিন ছিল ভর্তি গাড়ি। মালগাড়ির শেষে একটা ঘর। গার্ডের ঘর। জানলা আছে কপাট নেই। লোহার শিখ দিয়ে গাঁথা। এই জানলা দিয়েই সবুজ পতাকা, লাল পতাকা  দেখিয়ে সিগন্যাল দিতে হয়।

প্রথম দিন এত বড় একটা গাড়ি নিয়ে যাওয়া! একটা উত্তেজনা তো ছিলই। আসানসোল ছাড়িয়ে যখন মুরাড্ডি ঢুকছে তখন ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে গেল মালগাড়ি। দু’পাশে পলাশের জঙ্গল। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ। শীতের দিন। ঠাণ্ডা এবার জাঁকিয়ে পড়েছে। বিকাল ৩ টে। রূপা জানে সিগন্যাল না পেলে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। গার্ডের ঘরের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা থাকে। রূপা সেখানে দাঁড়িয়েই সামনের জয়চন্ডী পাহাড় দেখছিল। মনটা বেশ চনমনে আছে। কত লোকে কত কথা বলল। আড় চোখে চাওয়া চাওয়িও করেছে। সে সব পাত্তা দেয়নি রূপা । এমন একটা চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়। সে চিরকাল মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছে।

এদিকে যেমন গরম পড়ে তেমনই ঠাণ্ডা। শীতের পড়ন্ত বিকালে রোদে দাঁড়িয়ে ভালো লাগছিল রূপার। মালগাড়ি থেমে গেলে যেন ছন্দ পতন হয়। ভরা জঙ্গলের মাঝে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। গার্ডের ঘরে ঢুকে বোতল থেকে জল খেল রূপা। ফ্লাস্ক থেকে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার ফাঁকা জায়গাটায় এল। শীতের বিকেলে সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কত কথা মনে পড়ছে। জ্যাকেট, মাফলার, টুপি, মোজা পরেও শীত মানছে না। ঘরে গিয়ে বসল আবার। ছোট একটা আলো আছে ঘরটায়। তবে সব সময় জ্বলে না। একটা হ্যাজাক, ৫ ব্যাটারির টর্চ আছে। সে দুটোকে সামলে রাখল। বাইরে আঁধার ঘন হয়েছে।

ঘড়িতে তখন আটটা বাজছে। তখনও গহন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে মালগাড়ি। আকাশে একফালি চাঁদ। তারায় তারায় ঢেকে আছে পুরো আকাশ। কতক্ষণ এভাবেই কাটাতে হবে জানে না সে। তাই মনকে বোঝাতে শুরু করল রূপা। এমন সময় হঠাৎ পাদানিতে কিসের যেন আওয়াজ হল। কেবিনের সামনের খোলা জায়গাটায় দুটো সিঁড়ি আছে। সেটা দিয়ে কে যেন উপরে উঠল। ঘরের সামনের খোলা জায়গাটায় ছোটাছুটি করছে। রূপা হ্যাজাক হাতে এগিয়ে দেখতে গেল। শুনতে পেল, কে যেন অন্য পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাইরে বেরিয়ে আর কিছু দেখতে পেলো না রূপা।

অন্য যে কেউ হলে ভয়ে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। কিন্তু রূপা খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে দেখল, কেউ নেই। ভাবলো, বনবিড়াল হবে হয়তো। সবে কেবিনের দিকে পা বাড়িয়েছে এমন সময় আবার আওয়াজ হল। পিছন ফিরে দেখল, কিছু নেই। এবার একটু কাঁটা দিল গায়ে। কোন দিকে না তাকিয়ে সটান কেবিনে ঢুকে পড়ল সে। তখনই আবার আওয়াজ এল, কে যেন সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করছে।

পিছন ফিরে আর দেখার সাহস পাচ্ছে না রূপা। নিজের সিটে বসে সামনের খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। শুধু হাঁটা চলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এভাবেই কাটল বেশ কিছুক্ষণ। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছাড়ল। রূপা স্পষ্ট দেখল, সাদা চকমকে একটা কাপড় এপাশ থেকে ওদিকে চলে গেল। নামার আওয়াজটাও শুনতে পেল সে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে রূপার। উঠে দেখার ক্ষমতা নেই। মার কথা মনে পড়ছে, বারবার বলেছিল, এমন কাজে যাস না। 

তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। আর কখনও এমন ঘটে নি। ধু ধু মাঠে মালগাড়ি বহু বার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু না এমন ঘটনা আর ঘটেনি। তবে আজ আবার সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়েছে মালগাড়িটা। কে জানে কপালে কি আছে!

Leave a Reply