Jagat Seth :
ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার আগে বাংলা তথা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ীর নাম ছিল জগৎ শেঠ (Jagat Seth)। বড় বড় জমিদার, মহাজন ও অন্য ব্যবসায়ীরা তো বটেই। বলা হয়ে থাকে, বাংলার নবাবও বিভিন্ন প্রযোজনে তাঁর কাছে ধার নিতেন। জগৎ শেঠের মোট সম্পত্তির পরিমাণ (Jagat Seth net worth) ঠিক কত ছিল তা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। ইংরেজদের কাছে সিরাজ উদ দৌল্লাকে হারাতে মীরজাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর বাড়িতেই এই ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সিরাজ উদ দৌল্লা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। বাংলার দখল চলে যায় বিদেশিদের হাতে।
Jagat Seth. জগৎ শেঠ আসলে কী ?
‘জগৎ শেঠ’ কোনও এক জন ব্যক্তি নন? আসলে ‘জগৎ শেঠ’ ছিল একটি পারিবারিক উপাধি। বিপুল ধনসম্পদের মালিক হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতাও ভোগ করত এই পরিবার। এই পরিবার বসবাস করত সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে (Murshidabad)। জগৎ শেঠরা আদতে বাংলার মানুষ নন। তাঁদের আদি নিবাস রাজস্থানের জোধপুরের নাগোর অঞ্চলে।
জগৎ শেঠের জন্ম তারিখ:
অনেকেই জগৎ শেঠের জন্মতারিখ জানতে চান। কিন্তু এই প্রশ্ন কার্যত অবান্তর। এই বংশের প্রাচীন পুরুষ হীরানন্দ সাহু জোধপুর থকে ভাগ্য অন্বেষণে পটনায় আসেন। কথিত আছে, এক দিন তিনি পাটনা শহরের কাছে একটি জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেখানে কারও আর্তনাদ শুনতে পেয়ে তা অনুসরণ করে একটি ভাঙা প্রাসাদে পৌঁছন। দেখেন এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। হীরানন্দ তাঁর যথাসাধ্য সেবা করলেও সেই বৃদ্ধ মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি হীরানন্দকে এক গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যান। যার মধ্যে ছিল প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা।
সেই সময় পাটনা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। হীরানন্দ সল্টপিটারের (পটাশিয়াম নাইট্রেট) ব্যবসা শুরু করেন। সে সময় সল্টপিটারের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল ইউরোপিয়ানরা। সল্টপিটার ব্যবসার পাশাপাশি সুদে ঋণ দেওয়া অর্থাৎ তেজারতির কারবার চালাতে শুরু করেন তিনি। ফলে অচিরেই তিনি অন্যতম ধনী মহাজন হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর সাত ছেলেকে ব্যবসার জন্য দেশের সাত জায়গায় গদি খুলে দেন। কনিষ্ঠ পুত্র মানিকচাঁদ আসেন মুর্শিদাবাদে। তাঁকেই জগৎ শেঠ বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে।
জগৎ শেঠের বাড়ির ইতিহাস :
মানিকচাঁদের ব্যবসা ছিল ব্যাঙ্কিং, যা ছিল আসলে তেজারতির কারবার। বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে মানিকচাঁদ সেখানেও তাঁর গদি স্থাপন করেন। তখন বাংলা মুঘল শাসনাধীন। নবাব পদে ছিলেন মুঘল বংশীয় আজিম-উস-শান। তাঁর দেওয়ান ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। নবাবের সঙ্গে দেওয়ানের বিবাদ হয়। মুর্শিদকুলি খাঁ তদানীন্তন মুখসুদাবাদে (যা পরে তাঁর নামানুসারে মুর্শিদাবাদ হয়) চলে আসেন। মানিকচাঁদও তাঁর সঙ্গে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। মহিমাপুরে নিজের প্রাসাদ গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে এক সময় মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলি খাঁর অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও শ্রীবৃদ্ধিও ঘটতে থাকে।
মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নিজামতি পদ লাভ করে মুর্শিদাবাদে টাঁকশাল স্থাপন করেছিলেন। সেই টাঁকশালের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন মানিকচাঁদ। তৎকালীন দিল্লির বাদশা ফারুখশিয়রের কাছ থেকে মুর্শিদকুলি খাঁ মানিকচাঁদের জন্য ‘শেঠ’ উপাধি জোগাড় করে দেন। বিনিময়ে মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলিকে বিপুল অর্থ দিয়েছিলেন। মানিকচাঁদ অপুত্রক ছিলেন। তাই তিনি নিজের ভাগ্নে ফতেচাঁদকে দত্তক নেন।
জগৎশেঠের প্রকৃত নাম কি :
জগৎ শেঠ এর আসল নাম কি (Jagat Seth original name)? জানা যায়, ফতেচাঁদ প্রথম ‘জগৎ শেঠ’ নামে (Fateh Chand Jagat Seth) পরিচিত হন। মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু হলে তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার সুবেদার হন। ফতেচাঁদ তাঁর অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। ফতেচাঁদের সাহায্যে সুজাউদ্দিন দেড় কোটি টাকা রাজস্ব দিল্লিতে পাঠাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় জগৎ শেঠ তখন কী পরিমাণ সম্পদের মালিক! তাঁর অবর্তমানে ছেলে সরফরাজ খানকে জগৎ শেঠের পরামর্শ মেনে চলার উপদেশ দিয়েছিলেন সুজাউদ্দিন। কিন্তু সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে ছেলে সরফরাজ জগৎ শেঠের পরামর্শ নেওয়া তো দূরের কথা, ভোগবিলাসে আসক্ত সরফরাজ উল্টে জগৎ শেঠকে জনসমক্ষে অপমান করেন। আজিমাবাদের শাসনকর্তা আলিবর্দি খাঁকেও তিনি জনসমক্ষে অপমান করেছিলেন। আলিবর্দি খাঁ এরপরেই তাঁর দাদা হাজি আহমদ ও জগৎ শেঠের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সরফরাজকে গদিচ্যুত করেন।
জগৎ শেঠ উপাধি প্রথম কে লাভ করেন :
ফতেচাঁদ মারা যান ১৭৪৪ সালে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। বেঁচেছিলেন শুধু মহাচাঁদ। বিপুল ধন-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন পৌত্র মহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ।
জগৎ শেঠ কার উপাধি :
কে কাকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন? জানা যায়, মহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ এই দু’জনের মধ্যে মহতাবচাঁদ দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি লাভ করেন। অন্যদিকে স্বরূপচাঁদকে দেওয়া হয় ‘মহারাজ’ উপাধি। এতদিন বড় বড় জমিদার, মহাজন, অন্য ব্যবসায়ীরা এমন কি নবাবও দরকারে জগৎ শেঠের কাছে ধার নিতেন। ক্রমে ক্রমে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরাও জগৎ শেঠের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে শুরু করেন। জগৎ শেঠের নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয় কলকাতা ও চন্দননগরে।
জগৎশেঠ পরিবারের উত্থান ও পতন :
আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব হওয়ার পরে বাংলায় বর্গী আক্রমণ শুরু হয়। বর্গীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুদ্ধ করতে হয় নবাবকে। বলা হয়, এই যুদ্ধের খরচ মেটাতে নবাব জগৎ শেঠ মহাতাবের কাছে বিপুল ঋণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বর্গী আক্রমণ দমনে আলিবর্দি খাঁ সফল হন। তবে এই সাফল্যের পিছনে যে জগৎ শেঠের বড় ভুমিকা রয়েছে তা পাঁচ কান হতে দেরি হয়নি। তবে জগৎ শেঠের প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। আলিবর্দী খাঁ উপযুক্ত রাজস্ব দিতে না পারলে জমিদারদের শাস্তি দিতেন। সেই শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে বহু জমিদার জগৎ শেঠের কাছ থেকে ধার করতেন। বলা বাহুল্য, চড়া সুদের বিনিময়ে সেই ধার দিতেন জগৎ শেঠ। ফলে দিন দিন তাঁর প্রতিপত্তি ও বৈভব আরও বাড়তে থাকে।
তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে আলিবর্দি খাঁয়ের পরে সিরাজউদ্দৌলা নবাব হতেই। মোহনলালকে দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেন সিরাজ। এই মোহনলালের সঙ্গে জগৎ শেঠের সম্পর্ক ভাল ছিল না। আবার জগৎ শেঠ ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সিরাজের কাছে ইংরেজদের হয়ে বলতে গেলে উদ্ধত সিরাজ নাকি সবার সামনে তাঁকে চড় মারেন। বলা হয়ে থাকে, সেদিনই বাড়ি ফিরে সিরাজের ভাগ্যলিপি লেখার কাজ শুরু করে দেন জগৎ শেঠ! লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরাজের বিরুদ্ধে থাকা কয়েকজন জমিদারের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করেন। সবাই মিলে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করেন। সঙ্গে যোগ দেন মিরজাফর এবং ঘসেটি বেগমও।
Jagat Seth. শেষ অধ্যায়
তবে এই ষড়যন্ত্র রচনাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় জগৎ শেঠের কাছে। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজকে হারিয়ে ইংরেজরা জয়ী হওয়ার পরে জগৎ শেঠকে আর পাত্তা দিত না ইংরেজরা। বলা হয়, পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা জগৎ শেঠের টাকশাল লুট করে। এদিকে মিরজাফরের পরে বাংলার নবাব হন মিরকাশিম। মিরকাশিম ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হননি। ফলে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বাধে। ১৭৬৪ সালের বক্সার যুদ্ধে মিরকাশিম পরাজিত হন। তবে তিনি জগৎ শেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদকে বন্দি করে মুঙ্গেরে নিয়ে যান। সেখানেই পরে তাঁদের হত্যা করা হয়।
মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদের মৃত্যুর পর জগৎ শেঠ সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। ধার নেওয়া অর্থ আর ফেরত দেয়নি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংরেজরা কলকাতায় টাকশাল তৈরি করে। মুর্শিদাবাদ থেকে রাজকোষ সরিয়ে আনা হয় কলকাতায়। তাঁদের পতনে কফিনের শেষ পেরেক ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। বলা হয়, ১৯০০ সালের পরে জগৎ শেঠ পরিবার লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। তাঁদের বংশধরদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
জগৎ শেঠদের প্রাসাদে (Jagat Seth House) এখন গড়ে তোলা হয়েছে মিউজিয়াম। প্রাসাদে রয়েছে বহুমূল্য আসবাব পত্র, বন্দুক, পিস্তল, তলোয়ার, মশাল, খড়গ, ঢাল, গণ্ডারের চামড়া, হাত কামান, হাতির দাঁতের পাশা, দোয়াত, বেনারসি, সোনার তৈরি পোশাক, নকশীকাঁথা, লর্ড ক্লাইভের পোশাক, বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য এক অতি উচ্চমানের মসলিন কাপড় সহ নানা কিছু। প্রাসাদে ঢোকার মুখেই রয়েছে এক গোপন সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ। প্রাসাদে রয়েছে ভূগর্ভস্থ কক্ষ। সেই সব কক্ষেই নাকি টাকা-পয়সা, সোনা-দানা লুকিয়ে রাখা হতো। কিন্তু সেই বিপুল সম্পদ কোথায় গেল তা কেউ বলতে পারেন না। প্রাসাদে একটি রহস্যময় আয়না রয়েছে। এই আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের মুখ দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ দেহের অন্যান্য অংশ দেখা যায়।
আরও পড়ুন- ধ্বংসের মুখে প্রায় ১০ বিঘা জমির উপরে নির্মিত খাজা আনোয়ার বেড়
+ There are no comments
Add yours