করোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা কতটা জানি এবং কী কী জানা দরকার। What do we know and what do we need to know about Novel Coronavirus

COVID-19 মানেই মৃত্যু পরোয়ানা নয়। প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি মাইল্ড। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে পাঠানো জরুরি। মাত্র ৫ শতাংশের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার দরকার। অর্থাৎ আক্রান্তের অধিকাংশেরই এমনকি হাসপাতালেও যাওয়ার দরকার পড়ে না।

করোনা ভাইরাস নিয়ে আসল তথ্য

সংক্রমণ:

গলা ও ফুসফুসের ইপিথেলিয়াল কোষকে আক্রমণ করে এই ভাইরাস। সাধারণত গলা ও ফুসফুসে থাকে ACE2 রিসেপটর। SARS-CoV-2 ভাইরাস প্রথমেই যোগাযোগ গড়ে তোলে ACE2 রিসেপটরের সঙ্গে। ত্বকের উপরে যেহেতু ACE2 রিসেপটর থাকে না, তাই ত্বকের সংস্পর্শে এসে এই ভাইরাস ক্ষতি করতে পারে না। ভাইরাস দেহের ভিতরে ঢোকে নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে। আমাদের হাত হল আসল মাধ্যম যা ভাইরাসকে নাক, মুখ বা চোখে পৌঁছে দিয়ে থাকে। তাই ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোওয়া জরুরি। বার বার হাত ধুতে হবে।

ভাইরাসের ক্ষতিকর মাত্রা:

একটা ম্যাকাওয়ের শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে 700000 PFU (Plaque forming unit) ভাইরাসের দরকার। যদিও এই অবস্থায় প্রাণীর দেহে কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। তবে তার নাক ও লালা থেকে ছড়ানো ড্রপলেট বিপজ্জনক। তবে মানুষের শরীরে সংক্রমণের জন্য 700000 PFU এর চেয়ে বেশি ডোজের ভাইরাসের প্রয়োজন। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ইঁদুরের শরীরে ACE2 রিসেপটর সহযোগে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, মাত্র 240 PFU ডোজের SARS থেকেই সংক্রামিত হতে পারে। সেখানে নভেল করোনায় সংক্রমণের জন্য 70,000 PFU ডোজের ভাইরাসের দরকার পড়ে।

সংক্রমণ ছড়ানোর সময়:

সংক্রামিত একজনের থেকে অন্যের দেহে কতদিন সংক্রমণ ছড়াতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে সাধারণত ১০-১৪ দিনের সময়সীমা ধরা হয়ে থাকে। চিকিৎসা, আইসোলেশন, লকডাউন, কোয়ারান্টিনের মাধ্যমে সেই সময়সীমা পার করিয়ে সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ করা সম্ভব।

কারা সংক্রামিত হতে পারে:

একজনের শরীরে ভাইরাস ঢোকার পরে তাঁর শরীর্ উপসর্গ নজরে না এলেও তাঁর থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। বহু ক্যারিয়ারের শরীরেই নুন্যতম উপসর্গ দেখা যায় না। হাঁচি, কাশির সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে। কারণ ১০-১৪ দিনের সময়সীমার মধ্যে ভাইরাস থাকে আক্রান্তের লালা, থুথু ও মুখের মধ্যে।

কিভাবে আমরা আক্রান্ত হই:

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায়। তাই সাধারণত ৬ ফুটের চেয়ে কম দূরত্ব অথবা স্পর্শ এড়াতে হবে। তাই সরকারি ভাবে যে কোনও পাবলিক প্লেসে পরস্পরের মধ্যে অন্তত দেড় মিটার শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। হংকংয়ের একটি গবেষণা থেকে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। ফোন, দরজার হাতল, লিফটের সুইচ, কোনও সারফেস থেকেও ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে এ’সম্পর্কে বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি। তবে এসব ব্যবহার করার পরে হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধোওয়া দরকার।

সংক্রমণ ছড়ানোর হার:

একজন আক্রান্তের থেকে গড়ে 2.2 থেকে 3.1 জন সংক্রামিত হতে পারে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে আমরা সংক্রমণের এই হারকে কমিয়ে ফেলতে পারি।

এই ভাইরাস কোথা থেকে এসেছে:

বাদুরের স্যুপ খেয়ে এই ভাইরাস ছড়ায়নি। কারণ, রান্না হলে (বয়েল) ভাইরাস নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিল, SARS-CoV-2 ভাইরাস সরাসরি বাদুর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রামিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক জিনোম স্টাডি থেকে জানা গিয়েছে, বাদুর থেকে মাঝে এই ভাইরাস অন্য কোনও প্রাণীতে সংক্রামিত হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে মানুষের শরীরে এসেছে। অন্য একটি স্টাডি বলছে, SARS-CoV-2 ভাইরাসের একটি বংশধারা (lineage) মহামারী ছড়িয়ে পড়ার অনেক আগে থেকেই মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কিভাবে এই ভাইরাসের উদ্ভব হল: 

SARS-CoV-2 ভাইরাস হয় মধ্যবর্তী কোনও প্রাণীর শরীরে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় বিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের শরীরে জুনোটিক ট্রান্সফার হয়। অথবা মানুষের শরীরেই জুনোটিক ট্রান্সমিশনের পরে ন্যাচারাল সিলেকশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কোনটা ঠিক তা জানতে আরও স্টাডির প্রয়োজন। তাই এই মুহূর্তে SARS-CoV-2 ভাইরাসের মিউটেশন সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য আমাদের হাতে নেই।

কখন SARS-CoV2 এর উদ্ভব হয়েছিল:

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত SARS-CoV2 ভাইরাসে আক্রান্তের কোনও নথিবদ্ধ তথ্য নেই। তবে প্রাথমিক জিনোমিক বিশ্লেষণের পরে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝির মধ্যে প্রথম এর প্রকাশ ঘটে। এর অর্থ হল, বেশ কিছুটা সময় ধরে এই ভাইরাস সবার অজান্তে একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

প্রাণীদের আক্রমণ করতে পারে কি এই ভাইরাস:

মলিকিউলার মডেলিং থেকে জানা যায়, SARS-CoV-2 ভাইরাস মানুষ ছাড়াও বাদুর, গন্ধগোকুল, বাঁদর, শুয়োরের কোষকে আক্রমণ করে থাকে। তবে গৃহপালিত পশু বা ফার্ম অ্যানিম্যালদের আক্রমণ করে না। ডিম বা মুরগির মাংস থেকেও এই ভাইরাস ছড়ায় না।

একজন কি একাধিকবার আক্রান্ত হতে পারে:

আমাদের একবার হাম হলে অধিকাংশের বাকি জীবনের জন্য শরীরে ইমিউনিটি গড়ে ওঠে। খুব কমজনেরই দ্বিতীয়বার হাম হওয়ার নজির রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, করোনাভাইরাসে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা ম্যাকাওকে ফের ভাইরাস দিয়ে সংক্রামিত করা যায়নি। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে মানুষের শরীরেও আপাতত দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার নজির মেলেনি। তবে এই ইমিউনিটি কতদিনের তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি।

অসুস্থতার মাত্রা:

COVID-19 মানেই মৃত্যু পরোয়ানা নয়। প্রায় ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি মাইল্ড। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে পাঠানো জরুরি। মাত্র ৫ শতাংশের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার দরকার। অর্থাৎ আক্রান্তের অধিকাংশেরই এমনকি হাসপাতালেও যাওয়ার দরকার পড়ে না।

বিপদের দোরগোড়ায় কারা:

চিকিৎসা কাজে যুক্ত যাঁরা তাঁদের সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। ইটালির লম্বার্ডিতে প্রায় ২০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে গিয়েছেন। বয়স্ক মানুষজন বিশেষ করে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষজন যাঁদের আগে থেকে হার্টের সমস্যা, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ঝুঁকি অনেক বেশি।

মৃত্যুর কারণ:

অধিকাংশ মৃত্যুই ঘটে হয় রেসপিরেটরি ফেলিওরের জন্য অথবা রেসপিরেটরি ফেলিওরের সঙ্গে হার্ট ড্যামেজ হলে। ফুসফুসে লিকেজ হয়ে ফ্লুইড ঢুকে পড়ে। এর ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। মৃত্যু ডেকে আনে। বর্তমানে COVID-19 এর চিকিৎসা মানে ভেন্ট্রিলেশন সহ অন্যান্য সাপোর্টিভ সিস্টেমের মধ্যে রোগীকে নিয়ে গিয়ে ফেলা। বিভিন্ন থেরাপেটিক ট্রায়ালও চলছে। তবে তার ফল এখনও অজানা।

দুধের প্যাকেট বা খবরের কাগজ থেকে কি এই ভাইরাস ছড়াতে পারে:

প্লাস্টিক ও স্টেনলেস স্টিলের সারফেসে SARS-CoV-2 তিনদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। ভাইরাল লোড যদি 10000 PFU হয় সেক্ষেত্রে খবরের কাগজ ও কাপড়ের উপরে মাত্র ৫ মিনিট টিকে থাকতে পারে। দুধের প্যাকেট জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলেই হবে।

এই ভাইরাস কি বাতাসে ছড়ায়:

বাতাসে এই ভাইরাস 2.7 ঘন্টা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাই ব্যালকনি, টেরেসের মতো জায়গায় ভয় নেই।

তাপমাত্রার তারতম্যে কি এই ভাইরাস থেকে বাঁচা যাবে:

গ্রীষ্ম, বর্ষা যাই হোক, তাপমাত্রার বাড়া-কমা হোক বা আদ্রতার বাড়া-কমা, ভাইরাসের উপরে এসবের কোনও প্রভাব আছে কি না সে ব্যাপারে এখনও নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাতে নেই।

উপরের সব তথ্য ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও কারিগরি মন্ত্রকের তরফে পিআইবি’র মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। আশা করি, মনে বল পাচ্ছেন এবার। করোনা নিয়ে অহেতুক ভয় পাবেন না আর লাকডাউন মেনে চলুন অক্ষরে অক্ষরে। তাহলেই কেল্লা ফতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *